বিসিএস ক্যাডারে প্রথম-দ্বিতীয় হলে কী আসে যায়?

  © ফাইল ফটো

বিসিএস ক্যাডারদের প্রথম-দ্বিতীয় হওয়া নিয়ে যে এখন উম্মাদনা হচ্ছে পত্রিকা বা অনলাইনে সেটাকে রীতিমতো অসুস্থতা মনে হচ্ছে। গত ৫০ বছরে বিসিএস ক্যাডারে অন্তত ৫০ হাজার লোক নিয়োগ পেয়েছে বা অবসরে গেছে। তাতে কী দেশের খুব বেশি কিছু গেছে-আসছে? কেউ একটা ক্যাডারে প্রথম হলে কী যায় আসে? তাদের হিরো বানানোর কিছু দেখি না। আবার জিরো বানানোরও কিছু নেই। খুব প্রতিকূলতায় জীবন সংগ্রাম করেছে সেটা হয়তো কখনো কখনো অন্যদের জন্য উৎসাহের হতে পারে। কিন্তু কিন্তু প্রথম-দ্বিতীয় এসব নিয়ে নিউজ করাটাকে আমার নিজের কাছে অসুস্থতা মনে হচ্ছে। এটা কী নিউজ নাকি গাইড বিক্রির ব্যবসা?

বাংলাদেশে চাকুরিপ্রার্থীদের সমস্যা নিয়ে আমার চেয়ে বেশি নিউজ অন্য কেউ করেছে বলে দাবি করতে পারবে না। গোটা দেশের সব সাংবাদিক মিলে যতো নিউজ করেছে আমি একা তার চেয়ে বেশি নিউজ করেছি। আমি মনে করি বিসিএস পদ্ধতি, নিয়োগের জটিলতা, সংস্কার, প্রশ্নপত্র ফাঁস এসব নিয়ে নিয়ে নিউজ হতে পারে। আমি নিজে শত শত নিউজ করেছি প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানান অনিয়ম-বিচ্যুতি নিয়ে। কিন্তু কোনদিন কে প্রথম হলো, কে দ্বিতীয় হলো তা নিয়ে একটা নিউজও করিনি। করার ইচ্ছেটাও হয়নি কোনদিন। বরং সবসময় বলেছি বিসিএসটা জীবন নয়।

আমি মনে করি দেশের স্বার্থে এই বিসিএস উম্মাদনা বন্ধ হওয়া দরকার। কেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে প্রথম বর্ষের ছেলেমেয়েরা বিসিএস নিয়ে বসে যাচ্ছে সেসব নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। এসব নিয়ে নিউজ হওয়া দরকার। আবার আরেকদল যে বিসিএসের চাকুরিকে ছোট করেন সেটারও মানে নেই।

মনে রাখবেন সব পেশাকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। আপনারা যদি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-কৃষিবিদ-সাংবাদিকসহ অন্য সব পেশাকে মর্যাদা না দেন তাহলে সবাই পুলিশ বা প্রশাসনেই যেতে চাইবে। স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছেলেটা বিজ্ঞানে পড়তে যায়। ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। কিন্তু সে যখন দেখে তার পেশার মর্যাদা নেই, প্রশাসন ক্যাডারে থাকা লোকটাই সব ক্ষমতার অধিকারী, সে কিন্তু সেখানেই যেতে চাইবে। আর একবার যদি বুয়েট-মেডিকেল বা বিজ্ঞান বিভাগের ছেলেমেয়েরা তাদের সব লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিসিএস নিয়ে বসে যায় তাহলে কিন্তু দেশের ভবিষ্যত অনিশ্চিত।

একবার ভাবেন কৃষিতে পড়া সবচেয়ে ভালো ছেলেটা বলছে সে কৃষিতে যেতে চায় না পুলিশ হতে চায়! ঢাকা মেডিকেলের প্রথম হওয়া ছেলেটা বলছে সে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যেতে চায়! বুয়েটের সবচেয়ে ভালো ছেলেটা বলছে তিনি প্রশাসনে যেতে চান। এমন হলে কিন্তু দেশ আগাবে না। আমি মনে করি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। প্রত্যেকটা ক্যাডারে সমান মর্যাদা দেওয়া দরকার। আন্ত-ক্যাডার বৈষম্য দূর হওয়া দরকার।

ভাই আমি তো কোনদিন সরকারি চাকুরির লড়াইয়ে নামিনি। কোনদিন সরকারি চাকুরি করিনি। কিন্তু আমি আমার ৩৭ বছরের জীবনে অন্তত ৩৭ হাজার মানুষের জীবন ছুঁয়েছি আমার কাজ দিয়ে। আমার নিউজে বিসিএসের ফল সংশোধন হয়েছে, বহু নিয়ম কানুন বদলেছে, পুরো পরীক্ষা বাতিল হয়েছে, হাজারও ছেলেমেয়ে নতুন করে চাকুরি পেয়েছে।

এমন বহু উদাহরণ দিতে পারবো। এখন আমি যদি সাংবাদিকতটা না করতাম? আমি যদি বিসিএস ক্যাডারের পেছনে ছুটতাম তাহলে কী এই কাজগুলো হতো? আমি তো আমার জীবন নিয়ে ভীষণ সন্তুষ্ট। সবাইকে কেন ক্যাডার হতে হবে? না নিজের কাজ বা পেশাকে বড় করছি না। আমি বলতে চাইছি আমাদের সবাই মিলে কাজ করতে হবে।

আমার যে বন্ধু বা ছোট ভাইটা ব্যবসা করছে যেখানে হাজার হাজার মানুষ চাকুরি করছে তাকে দেখলে তো আমি শ্রদ্ধা করি। ওকে কেন সরকারি একটা অফিসে গিয়ে একটা সনদ নেয়ার জন্য অসম্মানিত হতে হবে? আমরা যে যার কাজটা কেন সৎভাবে করবো না? এখানে বড় ছোটোর কোন ব্যাপার নেই।

সমস্যা হলো আমাদের দেশে কেউ বিষয়গুলো বুঝতে চায় না। যে ছেলেটা পুলিশ ক্যাডারে চলে যায় তার কাছে মনে হয় পুলিশই সব। প্রশাসনের সমস্যা তিনি বুঝতে চান না। যিনি প্রশাসনে যান তিনি পুলিশকে মানুষ মনে করেন না। শিক্ষক-ডাক্তারদের তো বসার জায়গাও থাকে না। বাকিরা যখন দেখে সদ্য যোগ দেয়া ছেলেটা গাড়ি হাকাচ্ছে আর তিনি দশবছরেও বসার জায়গা পাচ্ছেন না তখন কিন্তু তার মধ্যে হতাশা বাড়ে। আপনারা যারা প্রশাসনে আছেন ভাবেন তো কাল যদি আপনি পুলিশে যেতেন তাহলে কী বলতেন? পুলিশে যাওয়া ছেলেটা ভাবেন প্রশাসনের কথা। ডাক্তারদের কথা ভাবেন। বিচারকেরা ভাবেন অন্যদের কথা। বিচারকদের সমস্যার কথা ভাবেন অন্যরা।

মনে রাখবেন, আপনি হয়তো প্রশাসনে আছেন কিন্তু যে পুলিশে আছে সে তো বিদেশ থেকে আসেনি সে আমার আপনার স্বজন। আনসার ক্যাডারে যে আছেন তিনিও তাই। দেখেন কয়েকদিন আগে অস্ট্রেিলয়ায় থাকা আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পেশায় তিনি প্রকৌশলী। তিনি বলছিলেন, এখানে কোন চাকুরি আপনি করেন সেটা ব্যাপার না, এখানে মোটামুটি শুরুর বেতন-পরের দিকে সুযোগ সুবিধা সবার সমান।

না কোন ক্যাডারের প্রতি আমার রাগ ক্ষোভ নেই। আমি মনে করি দেশের স্বার্থে বিষয়গুলো আলোচনা হওয়া দরকার। সব পেশার মর্যাদা দরকার। মনে রাখবেন আপনার ক্যাডারই যদি সব সমস্যার সমাধান করতে পারতো তাহলে তো বাংলাদেশে কোন সমস্যা থাকার কথা ছিল না। বলেন তো গত ৫০ বছরে কতোজন এসিল্যাণ্ড হয়েছেন সারাদেশে? কতোজন এসপি। কিন্তু আমাদের কোন খাতটা পুরোপুরি সমস্যামুক্ত হয়েছে? বলেন তো কৃষি ছাড়া বলার মতো কোন খাতে আমাদের বড় অর্জন আছে?

আবারও বলছি সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হোক। মনে হয় না এখন আপনারা যে যেখানে আছেন সেখানকার সুবিধা-অসুবিধা তো জানেনই সেটা বাদ দিয়ে অন্যের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করুন। তার প্রতি সহমর্মি হোন। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও শক্ত হতে হবে। ব্যবসা-উদ্যোক্তা হওয়ার পথটা তৈরি করতে হবে।

মনে রাখবেন, পেশার হিসেবে ব্রাহ্মণ-শুদ্র-সরকারি-বেসরকারি-পুলিশ-প্রশাসন-পররাষ্ট্র-ডাক্তার এই ধরনের ভাবনা বন্ধ হওয়া দরকার। সবার সমান মর্যাদা দরকার। আমাদের দেশে যা চলছে সেটা ভীষণ দৃষ্টিকটু। নানান ধরনের বৈষম্য দূর না করলে কখনোই দেশ আগাবে না। এই যে দেখেন সমন্বয় আর শ্রদ্ধার কী অভাব সেটা তো করোনার সময় টের পাচ্ছি আমরা।

আমি কয়েকদিন আগে বিসিএসের একটা গ্রুপে তরুণ চাকুরিপ্রার্থীরা আলোচনা করছে, জেলায় এসপি বেশি পাওয়ারফুল নাকি ডিসি? ভাবেন একবার। সরকারি চাকুরি করতে গিয়ে পাওযারের কথা আসছে কেন? সবাই না প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আমাদের বহু কর্মকর্তা নিজেকে কর্মচারী ভাবতে লজ্জা পান। চাকুরি পাওয়ার আগে আমি যে ছেলে বা মেয়েটাকে দেখি যোগ দেয়ার এক বছরের মধ্যে তার ভাব বদলে যায়।

পুলিশ-প্রশাসন-বিচারক-ডাক্তার-পররাষ্ট্র এমন কোন ক্যাডার নেই যেখানে আমার বন্ধু বা ছোট ভাই-বোনেরা নেই। আমি সবার কথা শুনি। বোঝার চেষ্টা করি। সবার আঙুল আরেকজনের দিকে। প্রশাসনের লোকেরা মনে করে পুলিশ কোন কাজ করে না। তারা ঘুষখোর। পুলিশ মনে করে বিচারকরা কী কাজ করে? করোনার সময় দেখেছি এক ক্যাডারের লোক আরেক ক্যডারের কাজকে ছোট করতে চাইছে। এটা কেমন দেশ?

আমি যদি বলি এই বিসিএস উম্মাদনার কারণে আমাদের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ধ্বংসের মুখে। কারিগরী দক্ষতা বা জ্ঞানচর্চা কোনটাই হচ্ছে না। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটাই বিশ্ববিদ্যালয় সেটা হলো বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবে একটা দেশ আগাতে পারবে? আমরা ভুলে যাচ্ছি বিসিএস ক্যাডার বা কোন একটা চাকুরিই জীবনের সব নয়। জীবনে দরকার সততা-মানুষের প্রতি ভালোবাসা।

নীতি নির্ধারকসহ সবাইকে বলবো, আসুন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করি। সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করি। আরেকজনের যন্ত্রটা বুঝি। উদারতা দেখাই। সবার কথা ভাবি। সবাই মিলে দেশটাকে বসবাসযোগ্য করি। যে যেখানে আছি সবাই সবার কাজটা ঠিকমতো করি। আরেকজনকে সম্মান দেই। সবাই মিলে মালা গাঁথি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বোধ দিক। ভালো থাকুন সবাই।

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও সাবেক সাংবাদিক


সর্বশেষ সংবাদ