করোনার কারণে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা

  © টিডিসি ফটো

করোনাকালে শিক্ষা সম্পর্কে টিভিতে সেদিন একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, এক শিশু বলছিল শুক্রবার ছুটির দিনের সাথে অন্যদিনগুলোর এখন আর কোন তফাৎ নেই। আমার মেয়ে নির্ঝরা - নাজিবাহ্ বলে, বাবা আমরা স্কুলের বান্ধবীদের মিস করছি। মিস করছি স্কুলের বারান্দা, ক্লাসরুম ও প্রিয় টিচারদের। এমনই পরিস্থিতি এখন।

প্রতিদিন স্কুলপ্রাঙ্গন ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় মুখর থাকতো। ছেলেমেয়েরা এদিক, ওদিক ছুটোছুটি আর দুষ্টুমি করতো এবং শিক্ষকদের নালিশ জানাতো। ক্লাসগুলো জমজমাট থাকতো ওদের সরব উপস্থিতিতে। ইতিপূর্বে এধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি কেউ কখনো হয়নি। দীর্ঘসময় বন্ধ থাকেনি স্কুল, কলেজগুলো। এই সময় যেন শেষ হবার নয়।

করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে গোটা বিশ্ব আজ হুমকিতে। এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বিশ্বের কোটি মানুষ। মারা যাওয়ার সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছে। করোনার এই মহামারীতে বিপর্যস্ত সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থাও। বিশ্বজুড়ে এখনো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ১৩০টি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যতিক্রম নয় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও। আমাদের দেশে গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা বন্ধ। কখন খুলবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। যদিও ৬ আগস্ট খোলার তারিখ দেয়া হয়েছে।

কোটি শিক্ষার্থীকে সামাল দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। করোনার হুমকিতে এইচএসসি, জেএসসি, পিইসি পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষাও।
দীর্ঘসময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীরা হতাশাগ্রস্ত। অনেকেই তো বইয়ের নামও ভুলতে বসেছে! ভুলতে বসেছে কোন ক্লাসে পড়ে সেটাও! কোন উপায় নেই। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জীবন রক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতেই হবে। করোনার প্রকোপ না কমলে কিংবা শতভাগ স্বাস্ব্যবিধি রক্ষার ব্যবস্থা না হলে স্কুল, কলেজ খুলে দেওয়া কোনভাবেই উচিত হবেনা। করোনার কারণে স্কুল, কলেজ বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ সঠিক ও যুক্তিযুক্ত। এর সাথে দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই। তবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালে কীভাবে ছাত্রছাত্রীদেরকে পড়াশুনায় ব্যস্ত রাখা যায় তার কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা। সচেতন পরিবারের সন্তানসন্ততিরা হয়তো অভিভাবকের তাগাদার কারণে পড়াশোনা করতে বাধ্য হচ্ছে। অসচ্ছল পরিবারে এই সুযোগটা নেই বললেই চলে। এমনিতে এসব পরিবার থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমত স্কুলেও আসতে পারেনা। বাবা, মাকে উপার্জনে সাহায্য করতে হয়।

স্থবির এই শিক্ষা কার্যক্রম কবে স্বাভাবিকে ফিরবে সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছেনা। এমতাবস্থায় শিক্ষামন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং দপ্তর শিক্ষার্থীদের বাড়িতেই পড়ার টেবিলে বসানোর নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সংসদ টিভির মাধ্যমে 'ঘরে বসে শিখি'তে প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস নেয়া হচ্ছে। বিটিভিতেও এর সম্প্রচার শুরু করা দরকার। ফেসবুক এবং অনলাইনের মাধ্যমে নানা গ্রুপ ও পেজ থেকে শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন। এত উদ্যোগের পরও সব শিক্ষার্থীকে পড়াশুনায় বসাতে কষ্টই হচ্ছে বৈকি! অনেকের জন্য এসব সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছেনা। কার্যকর একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার আগে শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাভাবিকতা ফিরছেনা-এটা নিশ্চিত। স্বাভাবিক হচ্ছেনা পৃথিবীও। নয়তো করোনাকে নিজে থেকেই নিষ্ক্রিয় হতে হবে। এছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।

করোনাকালে শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হলে অনলাইন মাধ্যমকে আরো বেশি করে কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে অসচ্ছল পরিবারের বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে কীভাবে অনলাইন মাধ্যমে যুক্ত করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। এসব পরিবারে প্রয়োজনে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে স্মার্টফোন, টিভি সরবরাহের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থায়ও যাতে এই কার্যক্রম চালু থাকে তার পদক্ষেপ নিতে হবে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে হলে প্রাথমিকভাবে একেকদিন একেক শ্রেণির ক্লাস নেওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির ক্লাসসমূহ সপ্তাহে বেশিরভাগ দিনে রেখে বাকিগুলো দুয়েকদিন করে রাখা যেতে পারে। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মতামত।

আকস্মিকভাবেই যেন সবকিছু এলোমেলো হয় গেলো। চীনে শুরু হতে না হতেই বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুতই। জানি, এ মহামারী কোন একদিন চলে যাবে। শিশুদের কলকাকলিতে আবার ভরে উঠবে স্কুল আঙ্গিনা আর খেলার মাঠ। শিক্ষাব্যবস্থা ফিরবে আগের অবস্থায়- এমন প্রত্যাশা শিক্ষাবান্ধব সকল মানুষের।

 

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক


সর্বশেষ সংবাদ