করোনাকালে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি— অশনি সংকেত

  © প্রতীকী ছবি

পুরো পৃথিবী জুড়েই চলছে করোনাভাইরাসের হত্যাযজ্ঞ। তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে আমরা গৃহবন্দী। আমাদের দেশে লকডাউনে গরীব-দুঃখী খেটে খাওয়া মানুষের অভাব অনটন চরমভাবে বেড়ে গেছে। দিন আনে দিন খায় এ শ্রেণির অনেক মানুষের কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পরিবারে একসাথে অবস্থান করছে বহু সদস্য। ফলে খাওয়া পড়ার খরচও বেড়ে গেছে। কিছু পরিবারের মেয়েশিশুরা নিকট আত্মীয় স্বজন দ্বারা শিকার হচ্ছে যৌন হয়রানির।

স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় পরিবারের উঠতি বয়সী মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পিতা-মাতা। অনিশ্চিত ও হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে চিন্তা করছেন এখনই বুঝি বিয়ে দেয়ার উপযুক্ত সময়। একটি শিক্ষা বর্ষের প্রায় অর্ধেক সময় যখন বিলীন হতে চলেছে তখন অভিভাবকগণ উঠে পড়ে লেগেছেন কন্যাদান করতে। খরচ বাঁচাতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা কমাতে চাচ্ছেন। অপরদিকে ভাইরাসের কারণে বিদেশ থেকে আসা শ্রমিক পর্যায়ের ছেলেরা পাত্র হিসেবে অনেকেরই পছন্দ তথা তালিকার শীর্ষে। তাছাড়া গ্রামে পুরুষদের অল্প বয়সে বিয়ের প্রবনতাও আগের চেয়ে বেড়েছে।

করোনার এই ভয়াবহ সময়ে যেখানে জীবন জীবিকা বিপন্ন ঠিক তখনই বাল্যবিবাহ বেড়ে চলেছে। এই সময়ে বিয়ে দিলে কম মানুষকে আপ্যায়ন করতে হবে, খরচও কম পড়বে এমন ধারণা থেকেই তড়িঘড়ি চলছে বিয়ের কাজ। শহরের চেয়ে গ্রামে এই হার বেশি। আবার শিক্ষিত পরিবারের চেয়ে তুলনামূলক কম শিক্ষিত পরিবারে এই সময়ে বিয়ে দেবার প্রবনতা বেড়েছে। মাধ্যমিক স্তরের মেয়েরা (১৩-১৬ বছর বয়সী) বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বেশি। কোনরূপ স্বামাজিক দুরত্ব ও স্বাস্থবিধি না মেনে অল্প পরিসর এ চলছে বিয়ের কাজ।

প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে না। ইউটিউব ঘেঁটে নিজেদের পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছে না। এরা অবাধে বিচরণ করছে,অলস জীবন যাপন করছে,  সামাজিক দূরত্ব মানছে না। মূলত অসচেতনতা, নারী শিক্ষার অভাব, সামাজিক কুসংস্কার, অনিশ্চিত করোনা পরবর্তী ভবিষ্যৎ এবং দারিদ্র্যতা এ সময়ে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। কিছু ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদের সংশোধন এর মাধ্যমে বয়সের হের ফের করে কন্যাশিশুকে বিয়ের বয়স উপযোগী করা হয়। লকডাউনে পরিবারের পিতা বা ভাইয়ের উপার্জন সীমিত হয়ে পড়ায় তারা এখনই কন্যা বা বোনের বিয়ে দিয়ে দেয়ার দারুন পক্ষপাতি। তাছাড়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এ বিষয়ে পূর্বের তুলনায় কম তৎপর। ফলস্বরূপ বাল্যবিবাহ বেড়েই চলেছে।

এই অবস্থা চলতে থাকলে অদুর ভবিষৎ এ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে, উচ্চশিক্ষিত নারীর সংখ্যা কমবে, সুশিক্ষিত মায়ের সংখ্যা কমবে, অল্পবয়সী ঝুকিপূর্ণ গর্ভবতীর সংখ্যা বাড়বে, অপ্রাপ্তবয়সী প্রসূতি মায়ের কারণে জন্ম নিবে রোগা শিশুর। এভাবে নতুন জন্মানো শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে। মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুহার বাড়বে। ছোঁয়াছে রোগের মত সমাজে ছড়িয়ে পড়বে নানা অসংগতি।

লেখক

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে গার্ল সামিট এ ঘোষণা করে এসেছেন ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১৫ বছরের নিচে বিয়ে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হবে। আর এ লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন- ১৯২৯ সংশোধন করা হয়েছে। এই আইনে সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাজী, অভিভাবক এমনকি যারা বাল্যবিবাহে সহযোগিতা করবে তারা সবাই শাস্তির আওতায় আসবে। অথচ করোনা পরিস্থিতির কারণে  প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে।

কর্তৃপক্ষের উচিত বর্তমানে বাল্যবিবাহ রোধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। সমাজের বিজ্ঞ, শিক্ষিত ও সচেতন মহলও এ বিষয়ে সাবধানতা প্রদর্শন করতে পারেন। সচেতন ও শিক্ষিত মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের বিয়ে বন্ধ করতে পারে। বাংলাদেশে ন্যাশনাল হেল্প লাইন, ১০৯ চালু আছে। এই সংখ্যাটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের সকল বইয়ের পিছনেও প্রিন্ট করে দেয়া আছে যেন কোথাও বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন সংঘটিত হলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে জানানো যায় এবং ব্যবস্থা নেয়া যায়। 

আসুন আরও সচেতন হই। বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করি। প্রত্যাশা করি, করোনার বিরুদ্ধে আমরা একদিন অবশ্যই জিতবো আর দূর হয়ে যাবে সব সামাজিক বিশৃঙ্খলা।

লেখক: প্রভাষক, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, জুরানপুর আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, দাউদকান্দি, কুমিল্লা