ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মকথা

  © টিডিসি ফটো

দেশের প্রাচীনতম, সর্ববৃহৎ এবং উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন। ৯৯ বছর আগে ১৯২১ সালের এই দিনে ঐতিহ্যবাহী এ বিশ্ববিদ্যালটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয়েছিল। শতবর্ষে পা দেয়া ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে খ্যাত আমাদের এ প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২১ সালের ১ জুলাই জাতি উদযাপন করবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার শতবাষির্কী। এ বছরই উদযাপিত হবে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীও।

শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম ও প্রতিষ্ঠা কোনো অনালোচিত বিষয় নয়। এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এম এ রহিম রচনা করেছেন The history of The Dacca University (পুণর্মুদ্রণ ২০১৩) নামে একটি গ্রন্থ। এতদপ্রসঙ্গে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে সৈয়দ আবুল মকসুদ রচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা (২০১৬), অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম কর্তৃক জ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সাথে আলাপচারিতার ভিত্তিতে রচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ (২০০০), অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম রচিত স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৬) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর, রতনলাল চক্রবর্তী রচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৪৭-১৯৭১), ২ খণ্ড (২০১৫), শেখ মাসুম কামাল রচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে রাজনীতি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, অধ্যাপক আয়শা বেগম রচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতি নিদর্শন (২০১৪), সৈয়দ রেজাউর রহমান রচিত গৌরবোজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (২০০১) এবং মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম রচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাকার ইতিহাস (২০১৪) ইত্যাদি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণমূলক লেখা সম্বলিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালমনাই অ্যাসোসিয়শন কর্তৃক ২০১০ সালে সৌরভে গৌরবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামে ২ খণ্ডের যে পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে এ প্রসঙ্গে এটিও একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। এছাড়াও পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী এবং বাংলার ইতিহাস বিষয়ে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও এর অগ্রযাত্রা নিয়ে আলোচনা রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে এতসব তথ্যসূত্র থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মকথা নিয়ে কেন এ নিবন্ধ রচনার প্রয়াস? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের আলোর বাতিঘর। শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও এর বিকাশ নয়, বরং আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশসহ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কেন্দ্র হিসেবেও এর রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি ইতিবাচক অর্জনে নেতৃত্ব দানের গৌরবময় কৃতিত্বের অধিকারী বিদ্যাপীঠ আমাদের প্রিয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। এর জন্ম ও বিকাশের সম্পর্কে যত বেশি আলোচনা ও চর্চা হবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল।

বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও অগ্রযাত্রা সম্পর্কে পূর্বাপর বস্তুনিষ্ঠ তথ্যাদি জানা অতীব জরুরি। কিন্তু পরিধিবহুল ও তথ্যসমৃদ্ধ অনেক গ্রন্থ থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে আগ্রহের অভাবে অনেকেই এ জানার পথ মারাতে চান না। আমি মনে করি একজন শিক্ষকতো বটেই একজন শিক্ষার্থীরও তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশকালেই এর ইতিহাস সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। নিজের প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস না জানলে, সে প্রতিষ্ঠানের অর্জন নিয়ে গর্ব করবে কিভাবে? তাছাড়া পূর্বসূরিদের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবেই বা কি করে? এসব ভাবনা থেকেই আমার এ নিবন্ধ রচনার প্রয়াস। যাতে শিক্ষার্থী ও সাধরণ পাঠকগণ স্বল্প পরিসর আলোচনা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কথা জানতে পারে। নিবন্ধটির কলেবর বিবেচনা করে এটি দু’পর্বে প্রকাশ করা হলো। নিচে দ্বিতীয় ও শেষ পর্বটি তুলে ধরা হল—

তিন

হিন্দু নেতাদের চরম বিরোধিতার মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণার বাস্তবায়ন হুমকির মুখে পড়েছিল সন্দেহ নেই। তবে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলমান নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারকে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে তাঁদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যান। লর্ড হার্ডিঞ্জও তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অনঢ় থাকেন। এ অবস্থায় ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল প্রেরিত এক পত্রে ভারত সরকার কর্তৃক ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত ভারত সচিব অনুমোদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার বঙ্গীয় সরকারকে সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাবসহ একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা পেশ করতে নির্দেশ দেয়। নির্দেশনা বাস্তবায়নে বঙ্গীয় সরকার ১৯১২ সালের ২৭ মে একটি কমিশন গঠন করে। ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের প্রধান ছিলেন ব্যারিস্টার রাবার্ট নাথ। অন্যান্য সদস্যগণ ছিলেন (১) বাংলার গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক জি.ডব্লিউ কুচলু, (২) কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ড. রাসবিহারী ঘোষ, (৩) নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, (৪) নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, (৫) ঢাকার জমিদার আনন্দচন্দ্র রায়, (৬) আলীগড়ের মাওলানা মুহম্মদ আলী, (৭) কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ.আর জেমস, (৮) ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ এ টি আর্চবোল্ড, (৯) কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সতীশচন্দ্র আচার্য, (১০) জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়, (১১) কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি ডব্লিউ পীক ও (১২) ঢাকা মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহীদ। ডি.এস ফ্রেজার এ কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। কমিটি প্রধানের নামানুসারে এটি Nathan Commission নামে পরিচিত। এ কমিটি মোট ২৫টি সাব-কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করে।

কমিটি সুপারিশ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চালিত এবং সরকারি অর্থায়নেপুষ্ট একটি রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এটি হবে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা এর শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আচার্য, উপাচার্য, সমাবর্তন ও কাউন্সিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। বাংলার গভর্নর হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। সরকার কর্তৃক উপাচার্য নিযুক্ত হবেন এবং তিনিই হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী। বিশ সদস্যের একটি কাউন্সিল থাকবে; এতে চেয়ারম্যান হবেন উপাচার্য এবং এ কাউন্সিল-ই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী সংস্থা। রিপোর্টে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ৫৩ লাখ টাকা এবং বার্ষিক খরচের জন্য ১২ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। নাথান কমিটি রমনা অঞ্চলে অধুনালুপ্ত পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানীর পরিত্যক্ত ৪৫০ একর জমির ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থাপনের সুপারিশ করে।

১৯১৩ সালে কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং একই বছরের ডিসেম্বরে তা ভারত সচিবের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) শুরু হওয়ায় নাথান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে অনিশ্চিয়তা দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বপ্ন চাপা পড়ে যায় কাগজের স্তুপে। তবে হাল ছাড়েননি পূর্ব বাংলার মানুষ। কারণ এ সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হিসেবে নতুন অপশক্তির অবির্ভাব ঘটতে পারে বলে তারা মনে করেছিলেন। তাই নবাব সলিমুল্লাহ নানাভাবে ব্রিটিশ প্রশাসনকে চাপ দিয়ে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে থাকেন। ১৯১৫ সালে ১৬ জানুয়ারি নবাব সলিমুল্লাহ তাঁর কলকাতার চৌরাঙ্গী বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রশাসনকে চাপ দেয়ার কাজটি হাতে তুলে নিয়েছিলেন টাঙ্গইলের নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিকে বারবার সামনে নিয়ে আসতে তাঁর সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নবাব সিরাজুল ইসলাম, স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, আবদুল করিম প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠার এ লড়াইয়ে এ কে ফজলুল হকের ভূমিকাও স্মরণযোগ্য। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ ছিল যে, কেবল মুসলমানদের খুশি করার জন্যই সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু যেহেতু সেখানকার মুসলমানদের বেশিরভাগই কৃষক, তাই “---they would benefit in no way by the foundation of a University” ফজলুল হক এ বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন।

১৯১৩ সালের ৪ এপ্রিল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে প্রদত্ত এক ভাষণে তিনি বলেন, “আমি পূর্ব বাংলার শিক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসরতার কারণ দূরীকরণের প্রয়াস বা মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের কেন্দ্রে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের গুরুত্বের বিষয়টি খাটো করে দেখতে চাই না। কিন্তু আমি এই মতের প্রতিবাদ করি যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় কেবল মুসলমানদের খুশি করার জন্য করা হচ্ছে। ভাইসরয় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সমান সুযোগ সুবিধার জন্য স্থাপন করা হচ্ছে।”

নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীও বারবার প্রভেন্সিয়াল ও ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিলম্বের বিষয়টি উত্থাপন করে তাঁর উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১৭ সালে ২০ মার্চ তিনি ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন এবং অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিল পাসের দাবি জানান। তাঁর এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তদানিন্তন ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, সরকার তাঁর পূর্বসূরি ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। আইনসভায় আরও জানানো হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিলের খসড়া প্রস্তুত রয়েছে। তবে যুদ্ধ সঙ্কটের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। যুদ্ধশেষে যথাসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যাদি তদন্ত, অভিজ্ঞ মহলের মতামতের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-দীক্ষা ও সংগঠনের জন্য করণীয় নির্ধারণ এবং ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিকল্পনা রূপায়নের লক্ষ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি লীডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার মাইকেল ই স্যাডলারকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেন। কমিটি প্রধানের নামানুসারে এটি The Sadlar Commission নামে পরিচিত। মুখ্যত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গঠিত হওয়ায় এটি “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন” নামেও পরিচিত। কমিশনের অন্য সদস্যগণ ছিলেন-স্বনামধন্য জে ডব্লিউ গ্রেগরী, স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ, প্রফেসর র‌্যামজে মুর, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ডব্লিউ.ডব্লিউ হর্নওয়েল এবং জিয়াউদ্দীন আহমদ। জি অ্যান্ডারসন কমিশনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। স্যাডলার কমিশনের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা সম্পর্কেও মতামত দানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল।

১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে দীর্ঘ সময় শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা শেষে ১৯১৯ সালের ১৮ মার্চ স্যাডলার কমিশন ভারত সরকারের কাছে এক বিশালাকার রিপোর্ট পেশ করে। কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত নাথান কমিটির সুপারিশকে যৌক্তি বলে গ্রহণ করে। তবে এটি আবাসিক না এফিলিয়েটিং হবে, তা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা পূর্ব বাংলার কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত করার পক্ষে মত দেন, যাতে পূর্ববঙ্গের উচ্চশিক্ষার্থী মুসলমান শিক্ষার্থীরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের হাত থেকে রেহাই পায়। পক্ষান্তরে বাংলার অমুসলিম জনমত ঢাকায় এফিলিয়েটিং বা মঞ্জুরি প্রদানের ক্ষমতাযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোরতর বিরোধিতা করেন। এ অবস্থায় স্যাডলার কমিশন মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। রিপোর্টে সুপারিশ করা হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। এর প্রকৃতি হবে টিচিং-কাম রেসিডেন্সিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন কলেজের পরিবর্তে বিভিন্ন আবাসিক হলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটরূপে গণ্য করা হবে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল হাউসের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আওতাভুক্ত এলাকারূপে গণ্য করারও পরামর্শ দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, এ সময় পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজ-দু’টি কলেজই ছিল। এ দু’টি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

১৯১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইম্পেরিয়াল রেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল উত্থাপিত হয়। এ বিলটি বিবেচনার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হলে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট বিলটি পরীক্ষার জন্য ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের একমাত্র বাঙালি মুসলমান সদস্য হিসেবে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ বিলটির পক্ষে জোরালো অভিমত পেশ করেন। সিনেটের অনেক সদস্যের বিরোধিতা সত্ত্বেও আইনের কিছু কিছু অনুচ্ছেদ, ধারা ও উপধারা সংশোধন পরিমার্জন পূর্বক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিলটির খসড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সম্মতি লাভ করে। ভারতীয় আইন সভা হয়ে সিলেক্ট কমিটির মাধ্যমে ১৯২০ সালের ১৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিলটি আইনে পরিণত হয়। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ The Dhaka University Act ( Act no XIII) গভর্নর জেনারেলের অনুমোদন লাভ করে। স্যাডলার কমিশনের ১৩টি সুপারিশের প্রায় সবগুলিই আংশিক পরমিার্র্জিতরূপে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্টে সন্নিবেশিত হয়।

১৯২১ সালের এক জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। কেননা এই দিনেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট বলে এদেশের গণমানুষের বহুল প্রত্যাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ঢাকার রমনা এলাকার উন্মুক্ত নৈসর্গিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত এলাকার ওপর বিলুপ্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের পরিত্যাক্ত ভবন ও বাংলোবাড়ি এবং ঢাকা কলেজের জন্য নির্মিত ভবনাদি (কার্জন হল ও সন্নিহিত ভবন) সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, অনেকেই দাবি করেন যে, নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন। এটি নেহায়েতই একটি গল্প, এর সপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। সরদার ফজলুল করিম জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাকের সাথে আলাপচারিতার ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ নামে যে গ্রন্থটি রচনা করেছেন সেখানে এ ভ্রান্তি নিরসনের জন্য প্রযোজনীয় তথ্য রয়েছে।

একই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন শেখ মাসুম কামাল তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে রাজনীতি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থেও। এম এ রহিমের The History of The Dacca University গ্রন্থেও এ দাবির সপক্ষে কোনো তথ্য নেই। নবাব সলিমুল্লাহ পূবৃবঙ্গের মুসলমানদের কছে পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রার অনেক আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাছাড়া এসময় তাঁর জমিদারি এস্টেট ও আর্থিক অবস্থা ৬০০ একর জমি দানের পর্যাযে ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক প্রয়াসে নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন অগ্রদুত। শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নসহ পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক কাজে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। বাংলার ইতিহাসে উচ্চাসন লাভ করার মতো অনেক কৃর্তি-কর্মের অধিকারী তিনি। তাই তাঁকে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে কোনো গল্প বা মিথ তৈরি করার প্রয়োজন নেই। এতে তাঁকে সম্মান নয়, বরং অসম্মানই করা হয় এবং এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ভারতের গভর্নর জেনারেল ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একাডেমিক রেজিস্ট্রার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগকে পাঁচ বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেন। ১০ ডিসেম্বর তিনি এ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোষাধ্যক্ষ (অবৈতনিক) ছিলেন জে.এইচ লিন্ডসে, প্রথম রেজিস্ট্রার খানবাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমদ এবং প্রথম প্রক্টর ফিদা আলী খান। ১৯৭৬ সাল থেকে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর পদ সৃষ্টি করা হয়। প্রথম প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন ড. মফিজুল্লাহ কবির।

কলা, বিজ্ঞান ও আইন-এ ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ (কলা অনুষদের অধীনে সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, ফার্সি ও উর্দু, দর্শন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি- মোট ৮টি; বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং গণিত- এ ৩টি এবং আইন অনুষদের অধীনে কেবল আইন বিভাগ), ৬০ জন শিক্ষক, ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী এবং ৩টি আবাসিক হল (ঢাকা হল, মুসলিম হল ও জগন্নাথ হল) নিয়ে এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্বপর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিশিষ্ট আবাসিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য ছিল। দেশ বিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ব বাংলার মাধ্যমিক স্তরের ঊধ্বর্তন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা দানের পাশাপশি অধিভূক্তিকরণ (affiliating) প্রতিষ্ঠানেও পরিণত হয়। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব ও কার্যপরিধির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। এক শতাব্দীর পথপরিক্রমায় অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও এর ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ৩টি অনুষদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট, ৫৬টির বেশি রিসার্চ সেন্টার, প্রায় দু’হাজার শিক্ষক ও ৩৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে।

চার

ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল এই ভূখণ্ডের মানুষের বহুদিনের স্বপ্ন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরুর ভেতর দিয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। তবে সে স্বপন বাস্তবায়নের পথটি মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বস্তুত অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে কলকাতার বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চরম বিরোধিতা ও প্রতিকুলতা এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে যে অনেকাংশে বিলম্বিত করেছিল ওপরের আলোচনায় পরিলক্ষিত হয়েছে। তাঁদের বিরোধিতা সম্পর্কে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্যে সরদার ফজুলুল করিম তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “ভাস্ট মেজরিটি অব দি মিডিল ক্লাস হিন্দুস অপোজড দি রিজোল্যুশান। দে অপোজড ইট টুথ এন্ড নেইল, স্যার আশুতোষ ইনক্লুডেড। স্যার আশুতোষের আপত্তির কারণ দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে তাঁর জমিদারি খাটো হয়ে যাবে।” তাঁদের এ বিরোধিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠালগ্ন এমনকি প্রতিষ্ঠার পরও অব্যাহত ছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজের অনুদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় এম এ রহিমের একটি উদ্ধৃতিতে। তিনি লিখেছেন, “The educated Hindus criticized the Dacca University as ‘Macca University’, ‘Fucca (Hollow) University’, and expressed that ‘a good college (Dhaka College) was killed to create a bad University.” নানা-ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো। তবে এটি ভবিষতে ঠিকবে কি-না এ নিয়েও তাঁদের সংশয় ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর আত্মকথা’র বরাত দিয়ে এম এ রহিম এ কথাও তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

কলকাতার বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিজীবীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব নিয়ে তাঁদের ভবিষ্যৎ বাণীও মিথ্যা প্রমাণীত হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন শতবর্ষের দোর গোড়ায়। কিন্তু এদেশের মানুষের মন থেকে তাঁদের পরম কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন তদানিন্তন কলকাতার বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ভূমিকার কথা কি মুছে গেছে? তাঁরা সবাই ছিলেন শিক্ষিত। তাই তাঁদের রুচি ও আচরণ মার্জিত ও উদার হওয়া কাম্য ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বরাবরই পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি তাঁদের উন্নাসিক ও অনুদার মনোভাবই ইতিহাসে দেখা যায়। তাইতো এ অঞ্চলের মানুষের কালচারকে তাঁরা ”এগ্রিকালচার” বলে কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেননি। পূর্ব বাংলার মানুষ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করে নিজেরা জ্ঞানালোকের জগতে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোকদের সাম্রাজ্যে হানা দিতে চাননি। তারপরেও আসে তাঁদের পক্ষ থেকে চরম প্রতিবন্ধকতা। এটি করে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সাথে যুক্ত রইলেন বটে, তবে তা নায়ক হিসেবে নয়, অন্য ভাবে। এটিই ইতিহাসের একটি ট্যাজেডি। বাঙালি হবে ভাই ভাই। অনুদার মনোভাব, সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা ও ধর্মীয় ভাবাবেগের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ফলে একাত্মা বা সম্মিলন নয়, বরং ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী রাজশক্তিরও অভিপ্রায় তাই ছিল। তাদের কূটচালে ধরা দেয়ার শেষ পরিণাম কি হয়েছিল- এটি আমাদের সবারই জানা।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। উল্লেখ্য যে, ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসে ১৯২১ সাল একটি স্মরণীয় বছর। এ বছরই ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। অন্য দু’টি হলো লক্ষ্নৌ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই গর্ব করার মতো অবদান রয়েছে। তবে অন্য দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ব্যতিক্রমি অর্জন রয়েছে। যেমন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ায় পূর্ব বাংলার কৃষিনির্ভর দরিদ্র মুসলমান সমাজের ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার দ্বার প্রসারিত হয়। মুসলিম সমাজে উচ্চশিক্ষার গ্রহণের ফলে বাংলায় একটি অধিকার সচেতন মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। অনেকের আশঙ্কা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে এটি একটি সাম্প্রদায়িক কলহকেন্দ্র (Communal Cockpit) এ পরিণত হবে। কিন্তু অভিযাত্রার সূচনা লগ্নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি আলোকপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিয়েছে যারা উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনাপুষ্ঠ। বঙ্গভঙ্গ রদের সান্তনা হিসেবে জন্ম নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকগণ শুধু এদেশের নয় বিশ্ব পরিমণ্ডলের জ্ঞান জগতকে আলোকিত করেছেন তাঁদের কীর্তি-কর্ম দিয়ে।

শতবর্ষের পথ পরিক্রমায় দেশজ ও বৈশ্বিক নানা পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক পাঠদানের পাশাপাশি মুক্তচিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ, গবেষণা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নতুন ও মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির মহান দায়িত্বটি যেমন পালন করেছে, তেমনি এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশ নামক একটি জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে নেতৃত্বদানসহ এদেশের সকল ইতিবাচক অর্জনে গৌরবময় ভূমিকা পালন করে ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান ও বিশ্ববিদ্যালযের পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা সমালোচনা চলছে। এসব আলোচনা একেবারে ভিত্তিহীন এমনটা দাবি করার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে বিরাজমান আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি এর চরিত্রগত কিছু পরিবর্তনও ঘটেছে। কিন্তু তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে আজও যেমন সক্রিয় এবং ভবিষতেও তা থাকবে।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: s_rahman_khan@yahoo.com


সর্বশেষ সংবাদ