বাজেটে গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট খাতে বরাদ্দ চাই

ড. এম. মেসবাহ উদ্দিন সরকার
ড. এম. মেসবাহ উদ্দিন সরকার  © টিডিসি ফটো

আসন্ন বাজেটের অধিবেশন বসবে ১১জুন ২০২০ তারিখে। করোনাকালীন এবছরের বাজেটে চিকিৎসাখাতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। শিক্ষাখাতেও এবার বাজেটে পরিবর্তন আনা অনাবশ্যক। লকডাউন কিছুটা শিথিল হওয়ায় কিছুকিছু সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত খুলছে বটে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে। বন্ধ থাকার কারণটিও সকলের জানা। অন্যতম কারণ হচ্ছে, করোনা বিস্তাররোধে যেসব নিয়মকানুন মেনে ক্লাস পরিচালনা করতে হবে তা এইমুহূর্তে প্রস্তুত নেই।

অর্থাৎ ভবনের প্রবেশ পথে থার্মাল স্ক্যানার বা থার্মোমিটার দিয়ে শিক্ষার্থীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করা, সম্ভব হলে জীবাণুনাশক টানেল স্থাপন করাসহ স্বাস্থ্যবিধির অন্যান্য নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনীয় অর্থও সময়ের ব্যাপার। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে লাশ আর লাশ।

সে কারণেই সরকার এবং শিক্ষামন্ত্রণালয় সরাসরি ক্লাসের পরিবর্তে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার উপর গুরুত্বআরোপ করেছে। গত সপ্তাহে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ভার্চুয়াল মিটিংয়ে দেশব্যাপী সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু করার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন। অর্থাৎ মাননীয় মন্ত্রী এবং সরকারের অবস্থান খুবই ইতিবাচক।

অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করার জন্য প্রথমেই দরকার দ্রুতগতির ইন্টারনেট। যা শহরাঞ্চলে থাকলেও গ্রামাঞ্চলে নেই। শহরাঞ্চলে ৫০০-৬০০ টাকার বিনিময়ে ব্রডব্যান্ড লাইনের কানেকশন নিয়ে আনলিমিটেড টাইম এবং আনলিমিটেড ডাটা অ্যাক্সেস করা যায়। উক্ত টাকার পরিমান বাড়ালে ডেটাট্রান্সমিশন এর গতি আরো আরো বাড়ে এবং সময়ও কম লাগে।শহর কিংবা গ্রামের যেকোন অঞ্চলে ৫০০ টাকা খরচ করার মত সাধ্য হয়তো একজন শিক্ষার্থীর আছে।

তাই শহরাঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হওয়া খুবই সহজ যদি থাকে তার ল্যাপটপ বা স্মার্ট ডিভাইস। গ্রাম কিংবা দ্বীপাঞ্চলে এখনো ব্রডব্যান্ড কানেকশন নেই। ফলে শিক্ষার্থীদেরকে মোবাইল ডাটার উপর নির্ভর করতে হয় যা খুবই ব্যয়বহুল। অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য এসব শিক্ষার্থীরা মোবাইল ডাটা (GB) ক্রয় করে যা খুবই অল্পসময়ের জন্য বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হয়।

তাই ৫০০ টাকা কেনো ৫০০০ টাকা দিয়েও প্রয়োজনীয় ডাটা ব্যবহার করতে পারবে না তারা। উল্লেখ্য যে, একটি এক ঘণ্টার ভিডিও ক্লাসের জন্য প্রায় ৭০০-১০০০ মেগাবাইট ডাটা প্রয়োজন হয়।অর্থাৎ একদিকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অন্যদিকে মোবাইল ডাটার অপ্রতুলতার জন্য গ্রামে থাকা বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

প্রকৃতপক্ষে, অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছলেও সত্যিকার অর্থে ইন্টারনেটের সকল সুযোগ সুবিধা এখনো গ্রামবাসীরা ভোগ করতে পারছে না। ইন্টারনেট সেবার মানে গ্রাম ও শহরের মধ্যে চরম বৈষম্য বিদ্যমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর)-এর এক জরিপে দেখা গেছে যে ৬৫% শিক্ষার্থী গ্রাম থেকে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। তারা এতটাই দরিদ্র যে প্রাইভেট টিউশনি বা অন্যকোনো কাজ (আউটসোর্সিং) করে তাদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে থাকে। অনেকে তাদের দরিদ্র পিতা-মাতাকেও সাহায্য করে থাকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তারা এখন দরিদ্র পিতা-মাতার সাথে গ্রামেই আছে, যেখানে নেই কোন কাজকর্ম, নেই কোন আয়-রোজগার।

এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা। এসব শিক্ষার্থীদের অনেকেরই নেই ল্যাপটপ বা স্মার্টডিভাইস। এতদসত্ত্বেও ওই জরিপ মতে গ্রামে অবস্থানকারী প্রায় ৭০% শিক্ষার্থী অনলাইন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

তাই অনলাইনে ক্লাস শুরু করার পূর্বে প্রথমেই নজর দিতে হবে গ্রামাঞ্চলের ইন্টারনেট অবকাঠামোর দিকে। শিক্ষার্থীদের হাতে সহজে এবং সহজলভ্য (সম্ভব হলে করোনাকালীন সময়ে বিনা মূল্যে) ইন্টারনেট সংযোগ তথা স্বল্পমূল্যে মোবাইল ডাটার নিশ্চয়তা। আরো দরকার শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্প সুদে অর্থের জোগান দেওয়া- যাতে সে ল্যাপটপ কিনতে পারে । অর্থাৎ গৃহীত যেকোন পদক্ষেপে যতটা সম্ভব সমতা, অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকা অতীব জরুরী ।

দেশ বাসী সকলেই জানে, মহামারী করোনার এই দুর্যোগ কালীন সময়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মনকে চাঙ্গা রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ পর্যন্ত ১৯টি প্রণোদনার মাধ্যমে লক্ষ কোটি টাকা বিতরণ করেছে বিভিন্ন খাতে। খেটে খাওয়া, দিনমজুর ও অসহায়, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মন্দিরের পুরোহিত, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিসহ বিভিন্ন নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

সারাদেশের অতি দরিদ্র সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের জন্য চালু করেছে রেশন কার্ড, বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে তাদের খাদ্যসামগ্রী। অর্থনৈতিক মন্দা পুষিয়েনেও য়ার জন্য আগামী তিন বছরের জন্য হাতে নিয়েছে মহাপরিকল্পনা। সব ভাতাই ঘরে বসে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্রহণ করছে দেশের প্রান্তিক জনগণ সবকিছুই সম্ভব হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অটল মনোবল এবং বিচক্ষণতার কারণে। প্রকৃতপক্ষে এসবই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, দেশের মানুষের প্রতি ভালোলাগা এবং ভালোবাসার হিঃপ্রকাশ। বিশ্বব্যাপী হয়েছে তা প্রশংসিত।

এমতাবস্থায় আসন্ন বাজেটে শিক্ষাখাতে গতানুগতিক ধারায় যেসব বরাদ্দ রাখা হয়, তার সাথে গ্রামীন শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট ফি মওকুফ করার প্রয়োজনীয় অর্থ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হলে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা খুবই উপকৃত হবে।সম্ভব হবে গ্রামের শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। দূর হবে শহর ও গ্রামের মধ্যকার প্রযুক্তির বৈষম্য । প্রতিটি গ্রাম পরিণত হবে এক একটি শহরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রী, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শুভদৃষ্টি একান্তকাম্য।

লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক (আইআইটি) ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ