বই আপাতত স্লাইড শো-পিডিএফ লিঙ্ক

  © সংগৃহীত

তাঁর কল্পনার তারিখটার প্রায় দেড়শো বছর আগে, তাঁরই জন্মশতবর্ষে যে পৃথিবীতে তেমন একটা দিনের সম্ভাবনা দেখা দেবে, বোধ হয় কল্পনাও করতে পারেননি আইজ়্যাক অ্যাসিমভ। ১৯৫১ সালে একটা গল্প লিখেছিলেন, ‘দ্য ফান দে হ্যাড’। গল্পের ঘটনাগুলো ঘটছে ২১৫৭ সালে।

জীবন্ত শিক্ষক, স্কুল আর কাগজে ছাপা বই— তিনটেই তখন প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিষয়। গল্পে ২১৫৭ সালের ১৭ মে মার্জি নামের মেয়েটি তার ডায়েরিতে লিখছে, ‘আজ টমি একটা আসল বই খুঁজে পেয়েছে।’ আসল একটা বই! কাগজে ছাপা, যার একটা ধরাছোঁয়ার শরীর আছে! বইটা আবার একটা স্কুল নিয়ে, যে স্কুলকে রীতিমতো ঘেন্না করে মার্জি। করারই কথা। ওর স্কুল মানে তো ‘স্কুলরুম’, শোওয়ার ঘরের পাশেই। সেখানে যন্ত্র-শিক্ষকের কাছে পড়তে হয়, হোমটাস্ক গুঁজে দিতে হয় যন্ত্রের নির্দিষ্ট স্লটে।

করোনার এই পৃথিবীতে কিছুটা হলেও এ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। অনেক স্কুলে শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস, পড়ুয়াদের বসতে হচ্ছে কম্পিউটার বা মোবাইলের সামনে। শিক্ষক অবশ্য এখনও মানুষ। কিন্তু কাগজে ছাপা, বাঁধানো, স্কুলের নতুন বই আপাতত ধরাছোঁয়ার বাইরে। বই আপাতত স্লাইড শো বা পিডিএফ লিঙ্ক। হোমটাস্ক পাঠাতে হচ্ছে ই-মেলে, সংশোধনও আসছে সেখানেই।

ই-বুকের দিকে যাত্রাটা এ দেশে শুরু হয়েছে এক দশকের বেশি নয়। সে যাত্রার গতি খুব ধীর। আর তা হোঁচটও খাচ্ছিল ই-বুক সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা আর প্রযুক্তিগত অক্ষমতার কারণে। এখনও অনেকের ধারণা, পিকচার ডকুমেন্ট ফরম্যাটে ছাপার আগের প্রি-প্রেস কপিটাকে আপলোড করে দিলেই, বা, কাগজে ছাপা বই স্ক্যান করে দিলেই ই-বুক তৈরি।

বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ বা শীর্ষেন্দুর রহস্য উপন্যাসের যে-সঙ্কলন কিন্ডলে পাওয়া যায় সেগুলো স্রেফ ছাপা বইয়ের স্ক্যান করা কপি। বেশ কিছু স্কুল-পাঠ্য বইয়ের কিন্ডল-সংস্করণও তা-ই। হরফ, পৃষ্ঠা বিন্যাস, ছবি ও অলঙ্করণ ব্যবহারের নিয়ম পর্যন্ত যে ই-বুকের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা, সেটা এখনও এ দেশের অধিকাংশ প্রকাশনার ধারণা বা প্রযুক্তিগত সামর্থ্যের বাইরে। ই-বুক-এর প্রধান ও প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য যে হাইপারলিঙ্কিং, সেটাই এখনও সিংহভাগ ভারতীয় ই-বুক’এ অধরা।


ইলেকট্রনিক বুক বা ই-বুক বলতে ঠিক কী বোঝায় সে প্রশ্নটার দুটো দিক। কী কী বৈশিষ্ট্যে সেটা বই, আর কী কী বৈশিষ্ট্যে সেটা ‘ইলেকট্রনিক’। ভারতের অধিকাংশ ই-বুক যে হেতু কাগজে ছাপা বইয়ের ই-সংস্করণ, তাই প্রশ্নটার দ্বিতীয় দিকটা আমরা তলিয়ে দেখিনি। কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রে পড়া যায় এমন বই মাত্রেই যে ই-বুক নয় তা বোঝার অবকাশ আমাদের হয়নি।

হাইপারলিঙ্কিং, অর্থাৎ ছবি বা লেখায় ক্লিক করে অন্য কোনও টার্গেট লোকেশনে পৌঁছে যাওয়ার ব্যবস্থা ই-বুকের প্রাথমিক শর্ত। থাকতে হবে সার্চেবিলিটি বা অনুসন্ধানযোগ্যতাও। কাগজে মুদ্রিত বইয়ে এই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যেত প্রধানত প্রবন্ধের বইয়ে, ইনডেক্স বা নির্ঘণ্টের মাধ্যমে। ই-বুকেও তা থাকতে বাধা নেই, কিন্তু তার সার্চেবিলিটি ইনডেক্সের অতিরিক্ত কিছু, যা পাঠককে অনেক বেশি স্পেস বা অবসর দেয়। অর্থ তার ফলে একটি বইয়ের ব্যবহারযোগ্যতার বৈচিত্রও তাতে বেড়ে যায় অনেক।

বই বস্তুটার সঙ্গে প্রায় ছ’শো বছর ধরে গড়ে উঠেছে একটি সংস্কৃতি। ই-বুকের বয়স এখনও আধ শতাব্দীও নয়। তাই সেটা এখনও সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচ্যই নয়। কিন্তু তার চেয়েও একটা বড় কথা আছে। এ দেশে মুদ্রণের আদিযুগেও ওই নতুন সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা এবং তাকে সমৃদ্ধ করে তোলার যে চর্চা ছিল, তার ছিটেফোঁটাও ই-বুক নিয়ে দেখা যায় না।

এর একটা কারণ হতে পারে এ দেশে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার এখনও নগণ্য, ফলে ভারতীয় ভাষায় ই-বুকের চাহিদা গড়ে ওঠেনি। আর একটা কারণও থাকতে পারে, ডিজিটাল মঞ্চের উপযোগী অথচ শিল্পসম্মত হরফ, যা আবার ইউনিকোড হওয়া বাঞ্ছনীয়, ভারতীয় ভাষায় এখনও তেমন তৈরি হয়ে ওঠেনি।

তবু এই অতিমারির সময়ে ই-বুক নির্ভরতা বাড়ছে। আর প্রকট হয়ে উঠছে আমাদের ডিজিটাল খামতিগুলো। অন্তত বাংলা প্রকাশনায় সেই খামতি যে পাহাড়প্রমাণ, সে কথা অনেকেই মানবেন। তার উপর যুক্ত হয়েছে একটা অকারণ আশঙ্কা, ই-বুক বুঝি মুছে দেবে মুদ্রিত বইয়ের জগৎকেই। যেমন ক্যাসেট মুছে দিয়েছে রেকর্ডকে, সিডি ক্যাসেটকে, পেনড্রাইভ ইত্যাদি সিডিকে। বইয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা কিন্তু একেবারেই তা নয়।

বিবর্তনের ধারায় কাগজে ছাপা বই যে যোগ্যতম হয়ে উঠল তার বড় কারণ মুদ্রণের সহজলভ্যতা। ই-বুক তার উল্টো অবস্থানে। কম্পিউটার এখনও এ দেশে সর্বত্রগামী হয়নি, হলেও তাতে বই পড়াটা খানিক ক্লান্তিকর। আর কিন্ডলের মতো শুধু বই পড়ার জন্যই নির্মিত যন্ত্র এখনও দেশের অধিকাংশ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তাই মার্জি-র মজাটার মৃত্যু এখনই নেই। ইতিমধ্যে আমরা যদি ই-বুক সম্পর্কে আর একটু সাবালক হয়ে ওঠার চেষ্টা করি, ক্ষতি কী! [লেখাটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত]


সর্বশেষ সংবাদ