কোভিড-১৯ রোগীর দেহে রক্ত জমাটের সম্ভাব্য কারণ

  © টিডিসি ফটো

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2) করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির প্রধান সাধারণ লক্ষণগুলো হচ্ছে, জ্বর, ক্লান্তি ও খুসখুসে শুষ্ক কাশি। কোভিড-১৯ আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্দি, গলা ব্যথা, নাক কনজেশন, তীব্র বা মাঝারি শ্বাস কষ্ট এবং শরীরে ব্যথা বা ডায়রিয়া দেখা যায়। কারও স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়ার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দেহের রক্ত জমাট (blood clot) বাঁধতে পারে।

২৯ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সংবাদ মাধ্যম "দ্য ওয়াশিংটন পোষ্ট" প্রদত্ত তথ্য মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ড. এস্থার ফ্রিম্যান জানান, অনেক কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর পায়ের আঙ্গুলে ফ্রস্টবাইট এর মত ফুসকুড়ি (প্রদাহ বা ক্ষত) দেখা গিয়েছে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এই ফুসকুড়ি হালকা লালচে থেকে রক্তবেগুনী হয়ে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অধিকিন্তু, এই ধরণের গোলাপি ব়্যাশ/ফুসকুড়ি দেহের বিভিন্ন জায়গায়ও দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরণের ব়্যাশ/ফুসকুড়ি দেহের রক্ত জমাটের কারণে হতে পারে।

যখন কোন আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি/ কাশি/থুতুর মাধ্যমে সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2) করোনাভাইরাস সমৃদ্ধ তরল ড্রপলেট নির্গত করে, সুস্থ ব্যক্তিরা তা শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে বা কোন পৃষ্টের উপরে থাকা ভাইরাস যুক্ত শুস্ক/আদ্র ড্রপলেটগুলো হাতের মাধ্যমে স্পর্শ করে মুখমন্ডলে পরিবাহিত করে। এইভাবে করোনাভাইরাস নাকে ও গলায় প্রবেশ করে। মানুষের শ্বাস তন্ত্রের (নাক, গলা, ফুসফুস) এপিথেলিয়াল কোষের এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) রিসেপটর ব্যবহার করে কোষে প্রবেশের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। এসিই২ রিসেপটর, কোষগুলোকে সুরক্ষিত না রেখে সংক্রমণ সূচিত করে কারণ ভাইরাস কোষে প্রবেশ করতে এই রিসেপটরের সাথে যুক্ত হয় (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")।

নভেল করোনাভাইরাস সার্স-কোভ-২ প্রথমে মানুষের নাক ও গলায় সংক্রমণ ঘটায়। যদি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাথমিক অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাসকে (SARS-CoV-2) প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তখন ভাইরাস বলিষ্ঠভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করতে শ্বাসনালী দিয়ে নিম্নমুখে অগ্রসর হয়। ভাইরাস ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোর বাহিরের আবরণে এক স্তরের "এপিথেলিয়াল কোষে" সমৃদ্ধ এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) রিসেপটরে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে ফুসফুস আক্রমণ করে (তথ্যসূত্রঃ ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ)। ভাইরাস প্রবেশের পর ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দূর্বল করে কোষগুলোকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে। শ্বাসনালির শাখা-প্রশাখা নিয়েই গড়ে ওঠে ফুসফুস। ফুসফুসের শাখা-প্রশাখার সর্বশেষ বিভাজন থেকে তৈরি হয় ক্ষুদ্র বায়ুথলিগুলো, যাকে এলভিওলি (alveoli) বলা হয়।

ফুসফুস করোনাভাইরাস দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সময় দেহের শ্বেত রক্ত কণিকা (white blood cells) কেমোকাইন (Chemokine) নামক জৈব পদার্থকে উন্মুক্ত করে (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")। কেমোকাইন হচ্ছে এক ধরণের সিগন্যালিং প্রোটিন যা দেহের ক্ষতের নিরাময়ের সময়ে (রক্ত জমাট প্রক্রিয়া, নতুন কোষ তৈরি) ও রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরণের কোষ থেকে নিঃসৃত হয়। নতুন কেমোকাইন আরোও অধিক পরিমানে দেহের রোগ প্রতিরোধী কোষকে জড়ো করে যা ভাইরাস আক্রান্ত ফুসফুসের কোষগুলোকে মেরে ফেলে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")। এ কারণে সৃষ্ট তরল ও মৃত কোষগুলি পুঁজে পরিণত হয়। এটি হচ্ছে কোভিড-১৯ রোগের ফলে সৃষ্ট নিউমোনিয়া (ফুসফুসে প্রদাহ)।

১০ এপ্রিল ২০২০ তারিখের 'থ্রম্বোসিস রিসার্চ' জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ অনুযায়ী, ডাচ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ১৮৪ জন নিশ্চিত নিউমোনিয়াসহ কোভিড-১৯ রোগীর মধ্যে ৩১% রোগীর রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার (thrombosis) রিপোর্ট পাওয়া গেছে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "সায়েন্স")। স্পেনের হাসপাতালে অনেক কোভিড-১৯ রোগীর দেহে জমাট রক্ত (ব্লাড ক্লট) পাওয়া গেছে ((তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ সাইট এবিসি সেভেন)। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের কার্ডিওভাসকুলার মেডিসিন ফেলো বেহনুড বিকডেলি বলেন, অনেক কোভিড-১৯ রোগীর দেহে উচ্চ মাত্রায় ব্লাড ক্লটের (রক্ত জমাট) উপজাত "ডি-ডাইমার" (D-dimer) পাওয়া গেছে।

"ডি-ডাইমার" হলো এক ধরনের প্রোটিন কমপ্লেক্স, যা মানবদেহে "প্লাজমিন" নামক এনজাইম দ্বারা "ফাইব্রিনোলাইসিস" প্রক্রিয়ায় জমাট রক্ত গলে উৎপন্ন হয় (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাজ্য ভিত্তিক স্বাস্থ্য মিডিয়া "মেডিক্যাল নিউজ টুডে") । কোন ব্যক্তির দেহে জমাট রক্ত (ব্লাড-ক্লট) পরিমাপে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ সচরাচর ডি-ডাইমারের পরিমাণ নির্ধারন করেন।

কোভিড-১৯ রোগের এক বিশেষ বৈশিষ্ট হলো রক্ত জমাট বাঁধা বা ব্লাড ক্লটিং। নিউমোনিয়ার মারাত্মক পর্যায়ে ভাইরাসের তীব্র সংক্রমণের কারণে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলো শ্লেষ্মা, রক্তের শ্বেত কণিকা, তরল পদার্থ ও ফুসফুসের ধ্বংসপ্রাপ্ত কোষের রাবিশ দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়। ব্লাড-ক্লট গুলো অক্সিজেনযুক্ত রক্ত চলাচল আরোও জটিল করে ফেলে; যা "থ্রোমবাস" নামে পরিচিত। কোভিড-১৯ রোগীর ক্ষেত্রে রক্তের জমাট (উচ্চ মাত্রার ডি-ডাইমার উপস্থিতি) অত্যধিক মৃত্যুর ঝুঁকি নির্দেশ করে। যদি একটি "থ্রোমবাস" ভেঙ্গে মুক্ত হয় এবং দেহের বিভিন্ন অংশে পরিভ্রমণ করে চিকিৎসকগণ ইহাকে "এমবোলাস" (embolus) বলেন।

দেহের অন্য জায়গার রক্ত জমাটগুলো ফুসফুসের মূল ধমনিগুলোতে (রক্তনালী) জমা হয়ে ধমনিগুলো ব্লক করে; যাকে পালমোনারি এমবোলিজম (Pulmonary embolism) বলা হয়। রক্তে উচ্চ মাত্রার "ডি-ডাইমার" লেভেল -- থ্রম্বোসিস ও পালমোনারি এমবোলিজম এর লক্ষণ নির্দেশ করে, ফলে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয় (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাজ্য ভিত্তিক স্বাস্থ্য মিডিয়া "মেডিক্যাল নিউজ টুডে"; যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েব সাইট "হেলথলাইন")। ২৩ এপ্রিল ২০২০ তারিখের রেডিওলজি জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ অনুযায়ী, ফ্রান্সের এক হাসপাতালে মারাত্মক কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ২৩% এর ফুসফুসে ভ্রাম্যমাণ ব্লাড-ক্লট (pulmonary embolus) পাওয়া গেছে।

কোভিড-১৯ মারাত্মকভাবে আক্রান্তের দেহে অতিরিক্ত সৃষ্ট "কেমোকাইন" রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন ছাড়াও, ক্ষতের সময় হেমোস্ট্যাসিস (Hemostasis) পর্যায়ে রক্ত জমাটে (ব্লাড ক্লট) গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে (তথ্যসূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মোলিকুলার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ)। নিউইয়র্কের আপস্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও ক্রাউস হেলথের ফুসফুস জটিল রোগ বিশেষজ্ঞ ড. ভিরেন কাউর বলেন, ভাইরাস কোভিড-১৯ রোগীর ফুসফুসে চাপ ও মারাত্মক প্রদাহের সৃষ্টি করে, যা রোগীর দেহে রক্ত জমাটে (ব্লাড ক্লট) প্ররোচিত করে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম এবিসি নিউজ)।

ভাইরাস সংক্রমণের সময়ে রক্ত জমাট প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। কিছু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এটি ভাইরাস বিস্তার রোধে হোস্টের (মানুষের) দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ (তথ্যসূত্রঃ ব্লাড জার্নাল)। অতিরিক্ত "কেমোকাইন" তৈরির মাধ্যমে মানবদেহে ভাইরাস সংক্রমণ রোধের প্রক্রিয়া -- রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে অধিকতর সক্রিয় করতে পারে।

চিকিৎসকগণের একটি দলের সুপারিশ হচ্ছে অল্প ডোজের হেপারিন (যা রক্ত জমাট বাধাগ্রস্থ করে) চিকিৎসা কোভিড-১৯ রোগীদের এই ধরণের রক্ত জমাট সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধক হবে। অন্য বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি সুপারিশ করেছেন, টিস্যু প্লাজমিনোজেন একটিভেটর/tissue plasminogen activator (tPA) -- কোভিড-১৯ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীদের দেহের জমাট রক্তকে ভাঙ্গায় চিকিৎসা হিসেবে সহায়ক হবে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য মিডিয়া "মেডিক্যাল নিউজ টুডে")।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ