শিক্ষক সংগঠন ও সরকারের উদ্দেশ্যে সবিনয় নিবেদন

  © টিডিসি ফটো

জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয় তা নতুন কথা নয়। সত্তর এর প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়, একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা বিশ্বের এ অঞ্চলের মানুষকে কীভাবে মানবতা ও মুক্তির স্বপক্ষে এককাতারে নিয়ে আসে তা বিশ্ব ইতিহাসের অংশ। বর্তমানেও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের আগ্রাসনের বিরদ্ধে ঐক্য ও জীবন রক্ষার নতুন ইতিহাস রচনায় বিশ্ববাসী নিয়োজিত। নানা বিভিন্নতা অতিক্রম করে দেশে দেশে মানুষের মধ্যে সংঘাত প্রবণতা কিছুটা হলেও কমেছে। অভ্যন্তরীণ বা জাতীয় রাজনীতিতে সরকারের সবকিছু ভালো অথবা সবকিছু খারাপ বলার মতো মানুষেরাও এখন অনেকটাই সংযত। জীবন রক্ষায় সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক মানবিক উদ্যোগের সাথে ঘরে ঘরে আবদ্ধ কোটি কোটি শিশু সন্তানদেও, তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগ ও ভাবনাও এখন জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্থান পাচ্ছে। করোনাভাইরাসকে যে মানুষের অদম্য সৃজনশীল উদ্ভাবনী শক্তি পরাভূত করতে যে কটি দিন বা মাস পার হবে সেই সময়কালে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দেশে দেশে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা উন্নয়নকর্মী ও পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়ার ভাবনা তাই এত প্রবল।

সারা বিশ্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কোটি কোটি শিক্ষার্থী যখন বাসগৃহে আবদ্ধ তখন তাদের শিক্ষা জীবন কীভাবে সচল রাখা যায় তা নিয়ে একের পর এক উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনলাইনে পাঠদান, দূরশিক্ষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে তথ্য পরিবেশন ইত্যাদি এই কর্মসূচির মধ্যে আছে। আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংসদ অধিবেশন প্রচারকারী চ্যানেল পঁচিশ মার্চ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ঘরে স্কুল কর্মসূচিতে ধারণকৃত পাঠদান পরিচালনা করছে। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য একই ধরণের কর্মসূচি সাত এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা। তবে টেলিভিশনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কর্মসূচিতে গুণগত টেকনিক্যাল মান ও শিক্ষার্থীরা তা কীভাবে গ্রহণ করছে এসব নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। এ কর্মসূচিতে শহরে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হলেও গ্রামাঞ্চলে ছাত্র-ছাত্রীরা তার সুফল কতটুকু পাবে তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। অন্যদিকে শিক্ষাপঞ্জি যেভাবে ধাক্কা খেয়েছে তাতে এবং জীবন জীবিকার তাগিদে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার হারও বেড়ে যেতে পারে। তবে আমি মনে করি এখনই এসব নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনা পরিহার করে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তাদের কিছুটা হলেও ব্যস্ত রাখার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো দরকার। নিউইয়র্কের ফোর্টহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক কামরুল হুদা কোভিড মোকাবেলায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ১. প্রচলিত পাঠদান ব্যবস্থায় পরিবর্তন অনস্বীকার্য। ২. শিক্ষার্থীদের গভীর শিক্ষা চাহিদা পূরণে আমাদের মিলিত উদ্যোগে খুঁত বা ঘাটতি থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষিতে আমাদের মেনে নিতে হবে।

ইউনেস্কো ব্যাংকক কেন্দ্র থেকে ই-মেইলে প্রায় প্রতিদিন আমাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা উন্নয়নের কর্মসূচির যেসব তথ্য ও তথ্যচিত্র কয়েক বছর ধরে পাঠিয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষার্থীরা কীভাবে বাসার মধ্যে লেখাপড়া করছে তার উপর আকর্ষণীয় সচিত্র বর্ণনা সম্বলিত কোনোকোনোটা ভিডিও হিসেবে ধারণকৃত বিষয় ও শিক্ষক অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া পরিবেশন করছে। এর মধ্যে রয়েছে, শিক্ষার্থী যে স্কুলে পড়ে অনলাইনে সে স্কুলের পাঠদান কর্মসূচি এবং বিভিন্ন শিক্ষা উন্নায়ন একাডেমি বা প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ধরণের কর্মসূচি। টেকসাসের কলিভিলে অবস্থানরত সপ্তম শ্রেণির আমার ২য় পৌত্র ইশান কাজীর মতে বাসায় বসে তাকে ক্লাস করতে হচ্ছে তা বোরিং হলেও দরকারী।

পৃথিবীর দেড়শর বেশি দেশে শিক্ষক সংগঠন নিয়ে গঠিত এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল বা ইআই শিক্ষকদের করণীয় ও তাদের জন্য করণীয় নিয়ে গত কয়েকদিন আগে নির্দেশনা প্রচার করেছে। সেখানে শিক্ষার সাথে বিশ্বব্যাপী করোনার আগ্রাসন মোকাবেলায় শিক্ষক ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের সম্ভাব্য কার্যকলাপের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের শিক্ষক শিক্ষার্র্থীরা সহায়ক নানা কর্মসূচি নিয়েছে। কয়েকটি জেলায় নারী শিক্ষকদের সৃজনধর্মী উদ্যোগের খবর যেমন, মাস্ক তৈরি করে পরিবেশন এবং দুস্থদের খাবার সরবরাহের মতো সংবাদ জানা গেছে। শিক্ষক সংগঠনের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠনের আঞ্চলিক শাখার সদস্যরা মাস্ক ও খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করছেন। বরিশাল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে শিক্ষকরা তাদের এক দিনের বেতন জাতীয় ত্রাণ তহবিলে দেবেন। তবে জাতীয় পর্যায়ে মূলধারার শিক্ষক সংগঠনের কমসূচি এখন পর্যন্ত আমার খুব একটা চোখে পড়েনি। শিক্ষক সংগঠনগুলো অতীতে শিক্ষদের কল্যাণে জাতীয় দুর্যোগে দায়িত্ব পালন করেছেন। আশা করি এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার। শিক্ষকদের মধ্যে যারা ন্যুনতম আর্থিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত যেমন, এমপিও, তাদেরকে অগ্রাধীকার দিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। এমপিভুক্তরা এমপিও বঞ্চিত শিক্ষক, কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারেন। অর্থাৎ তাদের নিজেদের বেতন থেকে তাদের সহায়তা দিতে পারেন। সে সাথে জাতীয় ত্রাণ তহবিলে ন্যুনপক্ষে একদিনের বেতন প্রদানে এগিয়ে আসতে পারেন।

শ্রেণিকক্ষে না থেকেও শিক্ষকরা কীভাবে শিক্ষাথীদের পড়াতে পারেন গুগল তার জন্য দশ মিলিয়ন ডলারের স্কুলশিক্ষণ তহবিল গঠন করেছে। টিচ ফ্রম হোম ও গুগল ফর এডুকেশন শ্রেণি কক্ষের বাইরে থাকা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও পাঠগ্রহণ অব্যাহত রাখতে ইউনেস্কো ইন্সস্টিটিউট ফর ইনফর্মেশন টেকনোলোজি ইন এডুকেশনের সমর্থন ও সহায়তায় এই কর্মসূচি গ্রহণ হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে করোনা মহামারির মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে ২৫ মার্চের পর এডুুকেশন ইন্টারন্য্যাশনাল বা ইআই বিভিন্ন দেশের সরকারদের উদ্দ্যেশে যে বারো দফা সুপারিশ দিয়েছে তারমধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালে শিক্ষার্থীদের পাঠদান অব্যাহত রাখতে সরকারের উচিৎ শিক্ষক ও তাদের সংগঠনের সাথে আলোচনা করে কর্মসূচি গ্রহণ। বিশেষ করে পেডাগোজি, ডিজিটাল উপকরণ ও প্লাটফর্ম বা মাধ্যম নির্ধারণে তাদের যুক্ত করা। বাংলাদেশের শিক্ষকদের একদিনের বেতন কর্তন সংক্রান্ত সরকারির সিদ্ধান্তের পূর্বেই শিক্ষক সংগঠনগুলোর উচিৎ স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া। সেই সাথে শিক্ষার্থীদের ঘরে বসে লেখাপড়া করানোর কর্মসূচিতে শিক্ষক সংগঠনগুলোকে যুক্ত করার প্রস্তাবও শিক্ষক সংগঠনগুলোর দিক থেকে সরকারের কাছে দেওয়া দরকার। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষক সংগঠন ও সরকারের কাছে আমার এই সবিনয় নিবেদন।

লেখক: জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর অন্যতম প্রণেতা
ই-মেইল: principalqfahmed@yahoo.com


সর্বশেষ সংবাদ