করোনায় সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্তই বাঁচাতে পারে অন্যের জীবন

বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা কমিউনিটি পর্যায়ের সংক্রমনে চলে গিয়েছে। তাই এখন সংক্রমন ঠেকানোর পাশাপাশি করোনার প্রতিকার নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। বাঁচানোর উপায় খুঁজতে হবে ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের। করোনার ড্রাগ-ভ্যাকসিন নিয়ে চলছে গবেষণা। তবে তা চলমান মহামারিতে কাজে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পূর্বে ব্যবহৃত কিছু ঔষধ বিভিন্ন কম্বিনেশন এবং ডোজে ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে।

এরই মধ্যে আশার আলো হিসেবে দেখা দিতে পারে সুস্থ হয়ে উঠা আক্রান্ত ব্যক্তির প্লাজমা বা রক্তরস। আমরা যখন কোন জীবাণু বা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন আমাদের শরীরে সেই জীবাণু বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় জীবানুকে ধ্বংস করার জন্য। জীবানু ধ্বংসের পর আমরা যখন সুস্থ হয়ে উঠি তখনও সেই সুনির্দিষ্ট জীবাণুবিরোধী অ্যন্টিবডি আমাদের রক্তে থেকে যায়। তৈরি হওয়া এই অ্যান্টিবডি নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে আমাদের শরীরকে পাহারা দেয়। যার ফলশ্রুতিতে একই ধরনের ভাইরাস দ্বারা সহজেই দ্বিতীয় বার আমরা আক্রান্ত হই না। কোন ভাইরাসের সংক্রমন থেকে সুস্থ হয়ে উঠা ব্যক্তির রক্তে ওই ভাইরাসবিরোধী অ্যান্টিবডি যুক্ত রক্তরসকে কনভালসেন্ট রক্তরস বলে। এই রক্তরসের মধ্যে থাকে না ভাইরাস, কিন্তু থাকে সেই ভাইরাস ধ্বংসকারী অ্যান্টিবডি।

বিভিন্ন অণুজীব এবং ফরেন পারটিকেলের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবডি বা ইমিউনোগ্লোবিউলিন তৈরি হয়। যেমন, ওমঊ, ওমএ, ওমগ ইত্যাদি। অনুজীবের সুনির্দিষ্ট একটি অংশকে আক্রমন করার জন্য এই অ্যন্টিবডিগুলো নিজেদের মধ্যে আবার লক্ষাধিক ধরনের সমন্বয় ঘটাতে পারে। অর্থাৎ যেকোন ভাবেই হোক, জীবাণুকে ধ্বংস করতেই হবে এমন লক্ষ থাকে তাদের।

ভাইরাসের সংক্রমন থেকে সুস্থ হয়ে উঠা কোন ব্যক্তির রক্ত থেকে অ্যন্টিবডি যুক্ত এই রক্তরস বা প্লাজমা নিয়ে নতুন আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করালে, ভাইরাল অ্যান্টিবডি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে। সুস্থ হয়ে উঠতে পারে নতুন আক্রান্ত রোগী। করোনা মোকাবেলায় সূচনা হতে পারে এক নব দিগন্তের। ভাইরাসের সংক্রমনের বিরুদ্ধ এই কনভালসেট রক্তরসের প্রয়োগ কিন্তু নতুন কোন বিষয় নয়।

এটি একটি শত বছরের পুরনো পদ্ধতি। যা বিভিন্ন মহামারীর সময় তড়িৎ ফলাফলের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এবং আন্তজাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও তার স্বীকৃতি মিলেছে। প্রায় শতবর্ষ আগে ১৯১৮ তে ঘটে যাওয়া স্প্যানিশ ফ্লু এবং ১৯৩০ এর দশকে হামের মহামারীতে এই কনভালসেন্ট রক্তরসের প্রয়োগে সাফল্য পাওয়া গিয়েছিলো। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের সার্স কোভিড , ২০০৯ সালের ইনফ্লুয়েনজা, সর্বশেষ ২০১৪ সালের ইবোলা মহামারীতেও কনভালসেন্ট রক্তরস প্রয়োগে সাফল্য পাওয়া গিয়েছে।

বর্তমানে চলমান কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও এই কনভালসেন্ট থেরাপির সাফল্য পাওয়া গিয়েছে আমেরিকা ও চাইনাতে প্রাথমিক ভাবে। আমাদের দেশেও ডাক্তাররা চেষ্টা চালাতে পারে এই পদ্ধতির প্রয়োগের। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো, নতুন করে ভ্যাকসিন বা ঔষধ তৈরি করতে হবে না, এবং এটি দূত কাজ করে। তবে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এই পদ্ধতির সাফল্য খুজতে।

১.দেখতে হবে দাতার এবং গ্রহীতা রক্তের গ্রুপ মিলে কিনা।
২ দাতার রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবডি আছে কিনা।
৩. দাতার শরীরের সমস্ত ভাইরাস মারা গিয়েছে কিনা।
৪. ডোজ শুরু করতে হবে আক্রান্ত হওয়ার শুরুতেই।

বেশী বয়ষ্ক, এবং অনান্য জটিল রোগে আক্রান্ত করোনা রোগীর ক্ষেত্রে জটিলতা কমাতে পারে এই পদ্ধতি। বাঁচাতে পারে প্রিয় জনের প্রাণ। ভয় পেয়ে সব কিছু ছেড়ে দিলে হবে না। আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আশায় বুক বাঁধতে হবে, হয়তো সফলতা আসবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, টাঙ্গাইল।

References:
https://link.springer.com/article/10.1186/s13054-020-2818-6
https://www.thelancet.com/article/S1473-3099(20)30141-9/abstract
https://www.jci.org/articles/view/138003 https://www.google.com/amp/s/www.wired.com/story/trials-of-plasma-from-recovered-covid-19-patients-have-begun/amp


সর্বশেষ সংবাদ