করোনাভাইরাস: যে সংকটের মুখে দক্ষিণ এশিয়া

  © ফাইল ফটো

দক্ষিণ এশিয়ার সবদেশেই এখন কার্যত ললকডাউন অবস্থা বিরাজ করছে। সারাবিশ্বের তিনভাগের একভাগ মানুষের বসতি এখানে। সবমিলিয়ে এখানে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ বসবাস করেন। চীন, স্পেন, আমেরিকা, ইতালির তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা কম। এই আটটি দেশে এখন পযর্ন্ত পাঁচ হাজার এর নিচে মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। 

আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি পাকিস্তান ও ভারতে। সীমিতভাবে বাংলাদেশ, ভারত,পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের যে দ্বিতীয় ধাপ বা ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ শুরু হয়েছে। কেননা,  ইতিমধ্যে এ সকল দেশে সবচেয়ে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে প্রবাসীরা এসেছেন। এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় ধীরগতিতে হলেও বিস্তার ঘটে পরবর্তীতে বিদ্যুৎ গতিতে।

তবে, দেরিতে হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ভারতে চলছে ২১ দিনের লকডাউন, বাংলাদেশে চলছে অঘোষিত লকডাউন, পাকিস্তান সরকার আইন-শৃঙ্খল রক্ষা বাহিনী নামিয়ে জনসমাগম বন্ধ করছে। নেপাল সরকার লকডাউনে সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছে। শ্রীলঙ্কা সরকার দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করছে।

তারপরও দক্ষিণ এশিয়ার এসকল দেশগুলোর অনুন্নত অবকাঠামোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেশগুলো নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার ও বেডের সংখ্যা কম। যেখানে আমেরিকা, ইতালি তাদের মোট জিডিপির পর্যায়ক্রমে ১৭.১ ও ৮.৯ শতাংশ ব্যয় করে স্বাস্থ্যখাতে, সেখানে বাংলাদেশ,  ভারত, পাকিস্তান স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে যথাক্রমে ২.৪ শতাংশ, ৩.৭ শতাংশ, ও ২.৮ শতাংশ।

কিন্তু, এগুলো ছাড়া আরো কিছু উদ্বেগের কারণ আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কর্মক্ষম জনগণও একটি উদ্বেগের কারণ। আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থার তথ্যমতে,  ভারত,নেপাল ও পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে ৮০.৯ শতাংশ,  ৯০.৭ শতাংশ ও ৭৭.৬ শতাংশ মানুষ দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে। যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্হিতি ভালো, তারা পেনশন, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পায়।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের এখন পযর্ন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে পন্থা, সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিতকরণ,  তা দক্ষিণ এশিয়ায় বাস্তবায়ন করা কঠিন।  কেননা, দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ঘনত্বের শহর মুম্বাই, করাচি, কলকাতা, ঢাকা রয়েছে।  এ কারণে,  এই দেশগুলোয় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

ফলে লকডাউন সত্ত্বেও ভারত, বাংলাদেশ,  পাকিস্তানে লোক সমাগম কমানো যাচ্ছে না। যদিও দেশগুলো সেনাবাহিনী ও আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনী নামিয়ে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কমানোর জন্য সামাজিক দুরত্ব সুনিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে।

তাছাড়া,  সংক্রমণ রোধের জন্য সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসাবে দীর্ঘ ছয় বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে ভিডিও সম্মেলন করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার সংগঠন সার্কের নের্তৃবৃন্দ। সেখানে এক কোটি ডলার দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। অন্যান্য দেশও চাদাঁ দিচ্ছে তাদের সাধ্যমতো। বাংলাদেশ দেবে ১৫ লাখ ডলার।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকির আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, জনমিতি। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের সুফল যেমন- মোবাইল ফোন, এসব দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পৌছালেও মানুষ এখনও বিজ্ঞানবিমুখ। একারণে, এখনও অনেক লোক ধর্মীয় এবং টোটকা চিকিৎসার ওপর আস্থাশীল। এর ফলে, গোমূত্র নিয়ে ভারতে এবং থানকুনি পাতা নিয়ে বাংলাদেশে গুজবের দেখা যায় এই সংকটকালেই।

পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, সারাবিশ্বের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় তথ্যবিভ্রাট ঘটছে মহামারি আকারে। তবে এতকিছু সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপ, ভূটান, নেপালে এখন পযর্ন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়নি কেউ, যা নিঃসন্দেহে আশার কথা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।

যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাই আচরণ-অভ্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য, সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করা, কঠোর আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে রোগের ছড়িয়ে পড়া কমাতে হবে। এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে শাসক থেকে বিরোধী, ব্যক্তি থেকে জনসাধারণ পর্যায়ে আস্হার সর্ম্পক গড়ে তুলতে হবে।

তথ্যবিভ্রাট কমিয়ে এনে উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য তথ্য মাধ্যম সুনিশ্চিত করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ, অভিজ্ঞতা বিনিময়ে পারে সম্ভাব্য ঝুঁকি কমাতে।

লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা


সর্বশেষ সংবাদ