বঙ্গবন্ধুর কবি ও কাব্য প্রেম

  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন ছিল গতকাল। সেহিসেবে জাতি এ বছর বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী পালন করছে।শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭মার্চ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৪ বছর। এর মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন বা প্রায় এক যুগ কেটেছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। বিস্তর কারাবাস এবং পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিভিন্ন অত্যাচারও এই আপোসহীন নেতার মনোবল ভাঙতে পারেনি। কারাজীবনকে তিনি অত্যন্ত সৃষ্টিশীলভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর রচনাসম্ভার অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারে রোজনামচা মূলত কারাজীবনেরই সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক জীবন নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে বড় একটি দিক কবি ও কবিতাকে অন্য রকম যে ভালোবাসতেন সেদিকটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকে কবিতা আবৃত্তি করতে যা তার বজ্রকণ্ঠ ও বক্তৃতার কারিশমা দেখে সহজে অনুমেয়। তিনি তাঁর জীবনে কাব্য চর্চা করে কবি হতে পারেননি কিন্তু হয়েছেন রাজনীতির কবি। তাঁর ভাষণে থাকতো রবীন্দ্রনাথের কবিতার উদ্ধৃতি এতে তাঁর ভাষণও হয়ে যেত কবিতার পংক্তি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত নিউজউইক পত্রিকা তাদের নিবন্ধ ‘দ্য পয়েট অব পলিটিক্স’-এ লিখেছিল,‘৭ই মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা।অপরদিকে কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ওপর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন, ‘অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধুর জীবনে দেশি বিদেশি কবিদের ছিল যথেষ্ট প্রভাব।অনেকের সঙ্গে স্বাধীনতার মহান এই স্থপতির ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক’। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রের লেখা বিভিন্ন কবিতার ছিলেন একজন দারুণ ভক্ত যা তার অসমাপ্ত আত্মাজীবনী ও জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা পর্যালোচনা করে সহজে অবগত হতে পারি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও তিনি ছিলেন নজরুল ভক্ত। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে স্মৃতি রয়েছে তাঁর। ২১ বছর বয়সের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আত্মজীবনীতে লিখছেন:'একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।ইতিহাসের আশ্চর্য মিল হলো, ১৯৪১-এ যে তরুণ শেখ মুজিব নজরুলকে কাছ থেকে দেখলেন, তাঁর গান শুনলেন; ঠিক ৩০ বছর পর ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনের পর ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশের বড় বড় সমস্যা নিয়ে যখন ভীষণ ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু, তার মধ্যে নজরুলকে ভুলে যাননি। ১৯৭২ সালেই তিনি অসুস্থ কবিকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধু।কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত এবং সুরারোপিত সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থের ‘চল্ চল্ চল্ গানটি

১৯৭২ সালের ১৩ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের তৎকালীন মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের রণ-সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়।স্বাধীন দেশে প্রথম নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে নজরুল একাডেমির স্মারকগ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার।’

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে করাচি ভ্রমণের আখ্যানেও গুরুত্বসহ এসেছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রসঙ্গ, 'বিকালে করাচি রওয়ানা করলাম, শহীদ সাহেব নিজে গাড়ি চালালেন, আমি তাঁর পাশেই বসলাম। পিছনে আরও কয়েকজন এডভোকেট বসলেন। রাস্তায় এডভোকেট সাহেবরা আমাকে পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলা ভাষাকে কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা করতে চাই? হিন্দুরা এই আন্দোলন করছে কি না? আমি তাঁদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম। শহীদ সাহেবও তাঁদের বুঝিয়ে বললেন এবং হিন্দুদের কথা যে সরকার বলছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তা তিনিই তাঁদের ভাল করে বুঝিয়ে দেলেন। আমার কাছে তাঁরা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’ আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু-একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাঁদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন।'
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের এমন অনেক কবিতা যে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ও হৃদয়ে ছিল তা তাঁর নানা রাজনৈতিক ভাষণ-বক্তৃতায়ও স্পষ্ট হয়েছে।বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন রবীন্দ্রনা। যতবার বঙ্গবন্ধু জেলে গেছেন ততবারই বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকতো সঞ্চয়িতা। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেছিলেন, ‘প্রতিবারই জেলে যাবার সময় বঙ্গবন্ধু সঞ্চয়িতাটা হাতে তুলে নিতেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবনেও রবীন্দ্রনাথ যে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। বেগম মুজিবের মতে, ‘কবিগুরুর আসন বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্ত:স্থলে।বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতন,সুখ - দুঃখ দৈন্য সর্ব মুহূর্তে তাঁকে দেখতাম বিশ্বকবির বাণী আবৃত্তি করতে।

‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে যেনো না করি আমি ভয়,’ অথবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’, প্রভৃতি অসংখ্য গানের টুকরো তিনি আবৃত্তি করে যেতেন দুঃখ-দৈন্য-হতাশায় ভরা অতীতের সেই দিনগুলোতে।’
বঙ্গবন্ধুর রবীন্দ্র প্রীতির কথা বলতে গিয়ে ১৯৭২ সালে বেগম মুজিব দৈনিক বাংলার সাংবাদিককে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় বলছিলেন, ‘কোন কারণে আমি মনক্ষুণ্ন হলে অতীতে বঙ্গবন্ধু আমাকে কবিগুরুর কবিতা শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিতেন।আজও শত কাজের চাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও এতটুকু সময় পেলেই সন্তানদের নিয়ে তিনি কাব্য আলোচনা করেন, আবৃত্তি শোনান পরিবারের লোকদের।'
১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে ঢাকায় আগত পাকিস্তানের বিরোধী নেতাদের সম্মানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুরোধে সানজিদা খাতুন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির পুরোটাই গেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পাঠাভ্যাসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার গান, কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ নিয়ে। শেখ মুজিব নিজেও গুনগুন করে গাইতেন রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্র সঙ্গীত। বঙ্গবন্ধুর যেকোনো জনসভায় রবীন্দ্রনাথের গানও পরিবেশিত হতো।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্তুরজুড়ে। ১৭ জুলাই ১৯৬৬ তারিখে লেখা তাঁর কারালিপিতে আছে রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি না পড়তে পারারও খেদ:আমার কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s Digest, টাইমস, নিউজউইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বই-ই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই।...কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুণী!'

১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইয়ুব খানের সামরিক কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে ( রেসকোর্স ময়দানে ) এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন ।সেদিন তিনি রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপীয়ার; এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা; যিনি একজন বাঙালী কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হইবেই।’ তিনি রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর থেকে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে রেডিও-টিভিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারেরও দাবি জানান।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দেন শেখ মুজিব তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি’ উদ্ধৃতিকারে বলেন। একই ভাষণে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’র ‘নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি! গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।' শ্লোকগুলো বলে তাঁর দেশে ফিরে আসার আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করেন। এভাবে বিভিন্ন সংকটে-ভাষণে তিনি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতেন।এসব থেকে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর আহবানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নূতন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন।প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই জনৈক সাংবাদিক যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কি?’ জবাবে চিরাচরিত হাস্যমুখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,’ আর বঙ্গবন্ধু সেটিকে ভালোবেসে ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি তারিখে মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের সামনে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিলেন। তারপর জনতার সে বিশাল স্রোতের মধ্যে থেকে একটু পরপর আরো কবিতা পড়ার অনুরোধ আসতে থাকে।শেখ মুজিব জনতার সে অনুরোধে একের পর এক রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে কিছু কিছু অংশ পাঠ করে শোনাতে লাগলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর রবীন্দ্র কবিতাপ্রীতি দেখে বিস্মিত হয়েছিল অনেকে।‘নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি’ এবং ‘নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস’ তার কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু বলেন, যৌবনে এক শান্তি সম্মেলনে চীন ভ্রমণে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আবিষ্কার করেছিলেন বিশ্বব্যাপ্ত রবীন্দ্রনাথকে:কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা বাংলা সাহিত্যের কবিদের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে যেমন চিরভাস্বর তেমনি এসেছে নানা দেশের, নানা ভাষার কবিদের প্রসঙ্গ।অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লাহোর সফরের বিবরণে পাই আইনজীবী খাজা আবদুর রহিমের আতিথ্যে কবি ইকবালের স্মৃতিবিজড়িত জাভেদ মঞ্জিলে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের তথ্য।

‘আল্লামা শুধু কবিই ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন।...আল্লামা যেখানে বসে সাধনা করেছেন সেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছি!’কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথা এসেছে।কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিচয়ের কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে তাঁর অবস্থানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এসেছে পঞ্চাশের দশকে চীন ভ্রমণে তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গ।'রাশিয়ার প্রতিনিধিদেরও আমরা খাবার দাওয়াত করেছিলাম। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমভের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশত্যাগ করে রাশিয়ায় আছেন। তাঁর একমাত্র দোষ তিনি কমিউনিস্ট। দেশে তাঁর স্থান নাই, যদিও বিশ্ববিখ্যাত কবি তিনি।'

শান্তিনিকেতনের এক সময়ের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীকে মুক্তির পরে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথকে আমি ভালোবাসি তার মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের জন্য। সঞ্চয়িতা-সঙ্গে থাকলে আমি আর কিছুই চাই না। নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর গান ও কবিতাই আমার বেশি প্রিয়। সব মিলিয়ে ১১ বছর কাটিয়েছি জেলে। আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল এই সঞ্চয়িতা। কবিতার পর কবিতা পড়তাম আর মুখস্থ করতাম। এখনও ভুলে যাইনি। এই প্রথম মিয়ানওয়ালি জেলের ন’মাস সঞ্চয়িতা সঙ্গে ছিল না। বড় কষ্ট পেয়েছি। আমার একটি প্রিয় গানকেই ‘আমার সোনার বাংলা’ আমি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত করেছি।'


সর্বশেষ সংবাদ