আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদাহরণ

ইংরেজি ‘এডুকেশন’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হইল ‘শিক্ষা’। ‘এডুকেশন’ শব্দটি আসিয়াছে ল্যাটিন শব্দ হইতে। এই শব্দটির ব্যাপারে ল্যাটিন ভাষায় তিনটি মৌলিক শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়। ইহার একটি হইল ‘এডুকেয়ার’। এই ‘এডুকেয়ার’ শব্দের অর্থ লালন করা, পরিচর্যা করা, প্রতিপালন করা। অর্থাত্ শিশুকে আদরযত্নের মাধ্যমে পরিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য সক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করিবার নামই হইল শিক্ষা। প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো বলিয়াছেন, ‘শিক্ষা হইল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ’। শিশুর অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলির আবিষ্কার এবং তাহার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনই শিক্ষার প্রধান কাজ। শিশুরা কোমল মনের অধিকারী। আনন্দঘন পরিবেশে থাকিতেই শিশুরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। শাসন, নিয়ন্ত্রণ, ভীতিকর ও বিষাদময় পরিবেশ শিশুর শিক্ষালাভকে বাধাগ্রস্ত করিয়া থাকে। এই কারণে শিশুশিক্ষা ও আনন্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন, ‘আনন্দহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়, যে শিক্ষায় আনন্দ নাই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হইতে পারে না।’ অর্থাত্ শিশুর শিক্ষায় স্বতঃস্ফূর্ততা ও আনন্দলাভের সুযোগ থাকিতে হইবে।

শুনিতে ভালো না শুনাইলেও বলিতে হয়, এই ক্ষেত্রে আমরা পিছাইয়া আছি। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিকে আমরা শিশুদের জন্য আনন্দময় করিয়া তুলিতে পারি নাই। অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শিশুদের সৃজনশীল শিক্ষার উপযোগী নহে। এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হইতেছে টাঙ্গাইলের গোপালপুরের ৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়গুলিকে শিশুদের মনস্তত্ত্বকে গুরুত্ব প্রদান করিয়া সাজানো হইয়াছে শৈল্পিকভাবে। পুরা স্কুলভবন গাঢ় লাল-সবুজের পতাকায় আপাদমস্তক মোড়ানো হইয়াছে। শ্রেণিকক্ষগুলির দেওয়াল চিত্রিত হইয়াছে দৃষ্টিনন্দন চিত্রে। শিশুরা ছবি আঁকিয়া, ছবি দেখিয়া রঙে মনের মাধুরী মিশাইয়া শিখন ও পঠন-পাঠন করিতেছে। গোপালপুর উপজেলায় মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬১টি, তাহার মধ্যে ৯৮টি বিদ্যালয়ে রূপান্তরের কাজ শেষ হইয়াছে, বাকিগুলিতে কাজ চলিতেছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতি বত্সর প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে লক্ষাধিক টাকা বরাদ্দ করিয়া থাকে। এই টাকা টুকটাক মেরামত, সংস্কার, শিক্ষাসরঞ্জাম ক্রয়, ক্লাসরুম সজ্জিতকরণ, বিভিন্ন দিবস পালন ইত্যাদি কাজে ব্যয় হইবার কথা। কিন্তু এই টাকা বহু ক্ষেত্রেই স্কুল কমিটি ও প্রধান শিক্ষকের জোগসাজশে নয়ছয় হইয়া যায়। ফলে দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় রংচং ওঠা, অপরিচ্ছন্ন। এমনকি পিলারের রড বাহির হইয়া থাকিবার মতো দৈন্য চিত্রও ফুটিয়া উঠে। এই সকল ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কেন এই দশা, তাহা লইয়া প্রশ্ন থাকিয়া যাইবে। গোপালপুর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিস দুই বত্সর ধরিয়া মাঠপর্যায়ে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করায় এই ইতিবাচক ব্যতিক্রমের সৃষ্টি হইয়াছে। এইজন্য গোপালপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে আমরা সাধুবাদ জানাই।

শিশুর শিক্ষা একটি স্পর্শকাতর ও গভীর মনোযোগ প্রদানের বিষয়। কারণ শিশু বয়সের শিক্ষণ সারা জীবনে গভীর প্রভাব ফেলিয়া থাকে। তাই এই শিক্ষা হইতে হইবে শিশুর মনস্তত্ত্ব বুঝিয়া। সেই কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির পরিবেশ শিশুর উপযোগী করিয়া তুলিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে গোপালপুর উপজেলা আমাদের জন্য উদাহরণ হইতে পারে। (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়)


সর্বশেষ সংবাদ