রোদসীর পেট ব্যথা ও নরকের এক রাত

  © সংগৃহীত

আমার একমাত্র কন্যা ‘রোদসী’, ঢাকার লক্ষীবাজার সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের প্লে-গ্রুপের ছাত্রী। ১৪ নভেম্বর রাতে দুধ এবং কোক কাছাকাছি সময়ে খাওয়ার পর হঠাৎ পেট ব্যাথা, বমি, হালকা জ্বর। রাতটা কাটলো এভাবেই। পরেরদিন একটু ভালো। scourge থাকায় সাপোজিটর দিয়ে পায়খানা করানো হলো কিছুটা। ধারণা হলো গ্যাসফর্ম হয়ে এমন হয়েছে।

সারাদিন মেয়ে ঘুমিয়ে কাটালো এক প্রকার। সন্ধ্যার পর আবার শুরু হলো পেটে ব্যাথা। ছিলাম শাহবাগে, খবর পেয়ে ছুটলাম টিকাটুলি সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালে, গিন্নিকেও সেখানে আসতে বললাম। ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার দেখে বললো এপেন্ডিসাইটিস। জরুরি আল্ট্রাসনো করাতে হবে। শুক্রবার এবং রাত তখন নয়টা ত্রিশ। তাদের ওখানে হবে না, টাইম ওভার। পরামর্শ দিলেন যেখান থেকে পারেন টেস্ট করান। ইটস আর্জেন্ট।

কয়েক যায়গায় খোঁজ নিলাম, বন্ধ হয়ে গেছে। ছুটলাম ঢাকা মেডিকেলে। টিকিট কেটে ইমার্জেন্সির দোতলায় ঢুকতেই মনে হলো নরকে চলে এসেছি! চারপাশে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুধু মানুষ আর মানুষ! দুর্গন্ধ! ময়লা! বিশৃঙ্খল চলাচল পেরিয়ে বেশ খানিক হেঁটে আট নম্বর কেবিনে পৌছলাম!

ইন্টার্ন ডাক্তার দুজন প্রায় শ’খানেক রোগীর কেবিন সামলাতে হিমশিম! রোদসীকে কোন রকম দেখে একই মন্তব্য করে পাঠালেন সার্জারীর কেবিন পাঁচ নম্বরে। সেখানে একজন সম্ভবত ডাক্তার আর একজন ইন্টার্ন মেয়ে সামলাচ্ছেন দুইশো রোগীর কেবিন। এছাড়াও আমাদের মতো ক্রমে আগত রোগীর চাপ তো আছেই!

এখানেও ডাক্তার একই কথা বললেন এবং আল্ট্রা সাউন্ড সহ রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা দিয়ে বললেন, দ্রুত পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে এখানে এসে দেখাতে। তখন ইন্টার্ন মেয়েটি বললেন, পারলে বাইরে কোথাও থেকে পরীক্ষা করাতে, এখানে অনেক ভীড়, তাই দেরি হতে পারে; কিন্তু দেরি করা যাবে না। মডার্নে যেতে বললেন।

দিশেহারা মনে হলো নিজেকে, ছোট ভাই রাহাত ছিল সাথে; মেয়েকে কোলে নিয়ে ছুটলো ও। এমন সময় একটা ছেলে এসে বললো, মডার্নের নাম্বার আছে তার কাছে। রাত তখন ১০টার উপরে। আল্ট্রাসাউন্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এই বলে কল দিল। পরক্ষণেই আমাদের নিয়ে হাটা দিল নতুন ভবনের দিকে।

বেশ খানিক হেঁটে নিচে নেমে বকশিবাজারের দিকে নিয়ে গেল মডার্ন ডায়গনস্টিক সেন্টারে। কিন্তু সাইনবোর্ড দেখে আমরা থমকে গেলাম! আধো অন্ধকারে সাইনবোর্ড, এটাতো মডার্ন হেলথ কেয়ার! ভেতরে ঢুকে আরও খটকা লাগলো! কিন্তু কিছু করার নেই। ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একশো টাকা হাতে দিলাম। পরীক্ষার সব রিপোর্ট পেতে রাত এগারোটা।

দুই হাজার টাকা বিল দিয়ে ছুটলাম সেই পাঁচ নম্বর কেবিনে। সিকিউরিটি গার্ড এবার ঢুকতে দিচ্ছে না, কারণ ডাক্তার নেই, ওটিতে গিয়েছে। তাহলে উপায়! সে বললো নিচে তিন/চার এ যান। ওখানে ওটি। গেলাম, ঢুকতে দিলো না, বললো পাশে সাত নম্বরে যান; গেলাম। সেখানে বললো পাঁচ নম্বরে যান, বললাম গিয়েছি, ডাক্তার ওটিতে। বললো চলে আসবে, ওখানেই যান।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো, অথবা যন্ত্রের মতো হয়ে গেছি যেনো! প্রায় দশ পনের মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্ব, রোদসীকে নিয়ে নামছি আর উঠছি। এদিকে অরণ্য’র দুশ্চিন্তা আরেক, কাল এবং পরশু মেয়ের স্কুলে পরীক্ষা, অনেক কষ্ট করে দুই বছর অপেক্ষা করে সেন্ট ফ্রান্সিসে চান্স পেয়েছে মেয়ে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে দুই বছর ধরে মেয়েকে আনা নেওয়া করেও গর্বিত সে। প্লে’র পরীক্ষা না দিতে পারলে লোয়ার কেজিতে উঠতে পারবে না এবং এখান থেকেই বিদায় নিতে হবে! আমি ধমক দিয়ে বললাম ‘জীবন আগে! না পড়ালেখা আগে!’

যাই হোক আবার গেলাম পাঁচ নম্বর কেবিনে। অপেক্ষা করতে করতে রাত সাড়ে বারোটা। আবার গেলাম ওটির সামনের রুমে। অন্য একজন ডাক্তার বসা সেখানে। ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, রিপোর্ট অনুযায়ী জরুরি অপারেশন করাতে হবে! আমি বললাম দেড় ঘন্টা ধরে রিপোর্ট নিয়ে বসে আছি। তিনি রাশভারি গলায় বললেন, কিছু করার নেই অপেক্ষা করুন, দেখতেই পারছেন অনেক রুগী।

কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম, রাহাত সেন্ট্রাল হাসপালে কথা বললো, সেখানে ৭০ হাজার টাকা লাগবে অপারেশন করাতে। উবার নিয়ে রাত একটার দিকে ছুটলাম সেন্ট্রালে। এরই মধ্যে মেয়ের পেটের ব্যাথা সেরে গেছে! বললো ক্ষুধা লেগেছে, আমাদেরও মনে পড়লো খাওয়ার কথা। অরণ্যকে (গিন্নি) বললাম আমরাতো খাইনি।

ছোট ভাই রাহাত ঢাকা মেডিকেলের সামনের হোটেল থেকে রোল করা ডিম পরোটা নিয়ে এলো। ক্ষুধার্ত চারজন খাচ্ছি আর ছুটছি উবারে। সেন্ট্রালে পৌঁছেই আবার শুরু হলো ব্যাথা। মেয়ে বললো, টয়লেটে যাবে। ডাক্তার ততক্ষণ রিপোর্ট দেখতে লাগলেন, ইউরিন ও ব্লাডে ইনফেকশন আছে। আল্ট্রা সাউন্ডের রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা একিউট এপেন্ডিসাইটিস। বললেন, রিপোর্ট অনুযায়ী সার্জারী করাতে হবে, কিন্তু পুনরায় পরীক্ষা করাতে হবে এখানে।

আর সেটা সকাল দশটার আগে হবে না, তাই ভর্তি হয়ে থাকতে হবে অথবা সকালে আসতে হবে। রোদসী টয়লেট থেকে এলো বেশ চঞ্চল ভঙ্গিতে! অরণ্য বললো, অনেক পায়খানা করেছে! রোদসীকে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো কোথায় ব্যথা? সে পাকামো করে বলে, এখন ব্যথা নেই, আগে ছিল। এই প্রথম ডাক্তার কিছুটা কনফিউজড। বললো, এপেন্ডিসাইটিস এর ব্যথা তীব্র হয়, তবে ভিন্ন লক্ষ্মণও হয়। যেহেতু বেটার ফিল করছে, তাহলে কালই আসুন।

পরের দিন সকালে মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় স্কুলে পরীক্ষা দিলো। অরণ্য মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে সোজা রায় সাহেব বাজারের মেডিনোভা ডায়গনস্টিকে। তারা দ্রুততার সাথে আল্ট্রা সাউন্ড পরীক্ষা করে বললেন, রোদসী’র কোনো এপেন্ডিসাইটিস হয়নি। রিপোর্টটি সঠিক নয়।

আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো, এই দেশে পদ্মা সেতু নয়, অন্তত পঞ্চাশটা বৃহৎ পরিসরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দরকার।

লেখক: সম্পাদক মগ্নপাঠ এবং নন্দিতা

ফেসবুক থেকে নেয়া


সর্বশেষ সংবাদ