সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র

আধুনিক সমাজে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। যে সমাজ-রাষ্ট্রে মানুষের বাকস্বাধীনতা থাকে, সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যমই সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের অদ্বিতীয় অবলম্বন। সংবাদমাধ্যম সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীকে আত্মসমালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। সঙ্গত কারণেই একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ ও সুশাসন নিশ্চিত করতে স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী শাসকগোষ্ঠীর ভূমিকা কখনোই ইতিবাচক ছিল না। সংবাদমাধ্যমকে তার সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে কিছুটা মুক্ত সংবাদমাধ্যম ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করা গেলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বরাবরই এ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে দেখা যায়। সংবাদমাধ্যম ও এর কর্মীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দায়িত্ব পালনে নানাবিধ বাধা, প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে জীবনহানি, জেল-জুলুম, অপহরণ ও জিম্মি হওয়ার ঘটনা ঘটেছে প্রতিনিয়ত। গত বছর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সারাবিশ্বে ৮০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর বাইরেও বিভিন্ন দেশে ৩৪৮ জন সাংবাদিককে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। ৬০ জন জিম্মি হয়েছেন বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে।

গোটা বিশ্বে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের ক্রান্তিকাল চলছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে সরকার আইন করায় এর বিরুদ্ধে একযোগে অভিনব প্রতিবাদ করেছে অস্ট্রেলিয়ার সব গণমাধ্যম। গত সোমবার দেশটির সব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ কালো কালিতে ঢেকে ছাপানো হয়। তারা সবাই প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদের ওপর মোটা করে কালি ঢেলে তার পাশে 'সিক্রেট' লেখা লাল সিল মেরে পত্রিকা প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষ্য, গণমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সরকারের 'গোপনীয়তা নীতি'র কারণে সাংবাদিকতার পরিসর ভয়াবহভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এটি স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি।

এর আগে বাংলাদেশেও গণমাধ্যমকে এ ধরনের প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের আমলে দেশের সব গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। স্বাধীনভাবে খবর প্রকাশের চেষ্টা করায় তার আমলে অগণিত সাংবাদিক হয়রানি ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার শেষ বছরে দু'জন সাংবাদিক মারা গেছেন, ১২ জন জেলে গেছেন, আটটি পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারের শাসনামলে কমপক্ষে ৩১টি প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডাক্তার মিলন শহীদ হওয়ার পর এরশাদ সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সেই মুহূর্তে সব সাংবাদিক মিলে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত কোনো পত্রিকা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সেই চূড়ান্ত মুহূর্তে 'বিদ্রোহ আর বিপ্লব চারদিকে' শিরোনামে আন্দোলনের বিশেষ বুলেটিন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হতো। আন্দোলনের খবর প্রচারের জন্য 'গণঅভ্যুত্থান' নামে আরেকটি বুলেটিন তখন প্রচারিত হয়েছিল।

বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রযন্ত্র সবসময় সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের মুখপত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে আসছে। এত সব চাপের মধ্যে নতুন নতুন সামাজিক মাধ্যমের অবাধ ব্যবহার সংবাদমাধ্যমকে আরেক দফায় সংকটে ফেলেছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তথ্য বিভ্রাটের যে চ্যালেঞ্জ তার সঙ্গে টিকে থাকতে সংবাদমাধ্যমকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের আয়ের একমাত্র উৎস হিসেবে বিবেচিত বিজ্ঞাপনের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নব্য ডিজিটাল মাধ্যমগুলোতে। সব মিলিয়ে এ সংবাদমাধ্যমকে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার। গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মুক্ত সংবাদমাধ্যম ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক
saifulksg@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ