রোহিঙ্গা বনাম পরিবেশের বিপর্যয়

মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস কারীরা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত যাদের বেশির ভাগই ধর্মে মুসলমান তবে অনন্য ধর্মালম্বীও আছে। ১৯৮২ সালে মায়ানমারের সামরিক সরকার নাগরিকত্ব আইন প্রদান করেন এবং রোহিঙ্গা দের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ১৯৮২ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা দের উপরে নির্যাতন করা হয় সর্বশেষ প্রতিফলন ঘটে ২০১৬-১২০১৭ সালে। জাতিসংঘের তথ্য মতে সবথেকে নির্যাতিত ও রাষ্ট্রবিহীন জাতিগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গারা। বর্তমানে প্রায় এগার লক্ষাধিক নির্যাতিত রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছ বাংলাদেশ।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের কারণে ২০১৭ সালের পরে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার পরিবেশ। উখিয়া ও টেকনাফের এক সময়ের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ সংরক্ষিত হাড়ি বনাঞ্চল আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান কারণগুলো হলো- রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ও জ্বালানির জন্য নির্বিচারে বন উজাড়; গাছপালা ও অন্যান্য বনজ সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত আহরণ ও পাহাড় কেটে বাড়িঘর নির্মাণ। যার ফলে এখানকার অনন্য জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব আজ বিলীন হতে চলেছে। অতি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে সার্বিক পরিবেশ।

ইউএনডিপি প্রকাশিত পরিবেশের ওপর প্রভাব বিষয়ক এক গবেষণায় রোহিঙ্গা সমস্যার জন্য উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় মোট ১১ ধরনের ক্ষতি হচ্ছে বলে জানা যায়। যার মধ্যে আছে অতিরিক্ত সংখ্যক টিউবওয়েল স্থাপনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির আধার কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির আধার দূষিত হওয়া। সুপেয় পানির অন্যান্য উৎস, যেমন- সীমিত সংখ্যক নদী ও খাল ইতিমধ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অতিরিক্ত গাছ কাটা ও পাহাড় ধ্বংসের কারণে বেশিরভাগ পাহাড়ি অঞ্চল এখন সারাবছর থাকে পানিশূন্য। যার ফলে, এ এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় জনগণ দীর্ঘমেয়াদে সুপেয় প্রাকৃতিক খাবার পানির অভাবে পড়তে যাচ্ছে।

তা ছাড়া অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাসহ ১৭ লাখ অধিবাসীর এ অঞ্চল পরিণত হচ্ছে এক কঠিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়ে। যার ক্ষতিকর প্রভাবে অচিরেই এ জনপদ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। জমে থাকা এসব বর্জ্যের বেশিরভাগই বর্ষাকালে বন্যার পানির স্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী নাফ নদসহ অন্যান্য প্রধান সংযোগ খালে। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মৎস্য সম্পদসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর ওপর।

মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি৷ কিন্তু পাহাড়গুলো কেটে তারা যে আবাসস্থল বানাচ্ছে, তাতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল৷ এক সময় হয়ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, নতুন করে হয়ত গাছও লাগানো যাবে, কিন্তু পাহাড়গুলোর ক্ষতি আর পূরণ করা যাবে না৷ অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে তো আর পাহাড়ের কাটা জায়গা পূরণ করা যাবে না৷ এই পাহাড়গুলো ১৫-২০ মিলিয়ন বছরের (দেড় থেকে দু’কোটি বছর) পুরনো৷ পাহাড়গুলো কাটার ফলে এখন বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মধ্যে পানি ঢুকে পড়বে৷ এতে যে কোনো সময় পাহাড় ধসে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে৷

প্রাথমিকভাবে দুই হাজার একর পাহাড়ি বনভূমি সরকারিভাবে বরাদ্ধ থাকলেও বর্তমানে প্রায় দশ হাজার একরের বেশি বনভূমি তে রোহিঙ্গা দের বসবাস। রোহিঙ্গা দের ত্রাণ ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হলেও কোনোধরনের জ্বালানি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। যার ফলে পাহাড়ি বনভূমি কেটে দৈনিক এক টনেরও বেশি জ্বালানি পোড়াচ্ছেন তারা। দিনে দিনে পাহাড়ি বনভূমি ধ্বংস করে ও পাহাড় কেটে মরুভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এলাকাকে।

অপরাধ প্রবণতার কথা যদি আমরা বলি!একটা কথা না বললেই নয়, শরণার্থী শিবির গুলি হল মৌচাকের মতো যার আশে পাশে মানুষ সহ কীট পতঙ্গ ও ভিড় জমায়। রোহিঙ্গা দের ক্ষেত্রেও যদি আমরা লক্ষ করি এদের নিয়েও কিছু সুবিধা বাদী ব্যবসা শুরু করেছে। অবশ্য তাদেরই বা দোষ কোথায়?যে ছেলেটি দেখেছে তার সামনে তার মাকে ধর্ষণ করতে, যে স্বামী দেখেছে তার সামনে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে তাদের মধ্যে একটা ভয়ানক ক্ষোভ আছে এটাকে দুর্বল পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে এসব রোহিঙ্গা দের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত করানোটা খুব সহজ কাজ নয় কি?

অল্প বয়সে তাদের মধ্যে বিয়ে প্রবণতাও বেড়ে চলেছে যার ফলে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি সহ অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়ার কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। অনেক রোহিঙ্গা মেয়েরা একটু বেশি ভালো থাকার স্বার্থে যৌন কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হচ্ছে যা স্থানীয় যুব সমাজকে ধ্বংস করার জন্য একটা বড় ধরনের ঝুঁকি।

দিনে দিনে রোহিঙ্গারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।ইতিমধ্যে তেতাল্লিশ জন সেখানে খুন হয়েছে যার মধ্যে একজন বাংলাদেশী স্থানীয় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক। যার ফলে সাংবাদিক ও স্থানীয় লোকজন সহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা ও নির্জনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। আতঙ্কে নিজেরাই নিজেদের দেশে প্রবাসীর মত বসবাস করছেন কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা। আরও অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে এ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে এই রোহিঙ্গা দের কারণে। তারা সভা সমাবেশ করার মাধ্যমে তাদের শক্তিরও জানান দেওয়া শুরু করেছে কেননা রোহিঙ্গা দের তুলনায় স্থানীয়রা অনেক কম প্রায় রোহিঙ্গা দের অর্ধেক স্থানীয়রা।

রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি মোকাবেলায় বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ কিছু দেশি-বিদেশি সংস্থা খালি ও পরিত্যক্ত জায়গায় গাছের চারা রোপণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমির তুলনায় অপ্রতুল। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে রোহিঙ্গাদের কারণে ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাই তাদের প্রত্যাবাসন সহ অতি দ্রুত এই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ সম্পাদক-পরিবেশবাদী যুব সংগঠন “গ্রীন ভয়েস” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা


সর্বশেষ সংবাদ