শুধু কথায় মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা যায় না

দেশে একেকটা প্রতিকূল পরিস্থিতি আসে আর কারো কারো ব্যর্থতাকে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যায়। এবার যেমন ডেঙ্গু এসে সবার সামনে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের অক্ষমতাকে মেলে ধরেছে। ডেঙ্গু প্রসঙ্গে শুরু থেকেই মেয়র মহোদয় অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। যখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, তখন তিনি বলছেন ঢাকা শহরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক। যখন ঢাকা শহরের হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ধারণের ঠাঁই নাই, যখন মৃত্যু এসে ডেঙ্গু রোগীদের দ্বারে দ্বারে হানা দিতে শুরু করেছে, তখন তিনি বলছেন, ‘এসব গুজব’।

নগরবাসী ইতিমধ্যে তার ডেঙ্গু সম্পর্কিত বচনে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। এইসব উদ্ভট কথা তিনি কোথায় পান? কে তাকে ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত প্রদান করেন? নগরালয়ে যে একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আছেন, তার কাছ থেকে কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কাছ থেকে কি নগরপিতা ডেঙ্গু পরিস্থিতির উপর নিয়মিত ব্রিফ নেন?

আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরেক কাঠি সরেস। সম্প্রতি তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এক সমাবশে ডেঙ্গু মশার বংশবৃদ্ধিকে রোহিঙ্গাদের বংশবিস্তারের সাথে তুলনা করেছেন। টুকটাক লেখালেখি করতে গিয়ে কবিতায় উপমার ব্যবহারে সতর্ক হতে হয় বলে শিখেছিলাম। রাজনীতিতে উপমার ব্যবহার অনেকটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন অনেক রাজনীতিবিদ। অথচ সেই উপমার ব্যবহারকে অত্যন্ত অমানবিকতার পর্যায়ে নামালেন আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। যে রোহিঙ্গারা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মা বলে ডাকেন, তাদের সম্পর্কে এমন কটু কথা বলতে বাধলো না স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাহেবের। এই দু:খ দেশবাসী কোথায় রাখবে?

মহামারী শব্দটা শুনলে অনেক প্রবীনের কাছেই মনে হয় ‘কোন একটা বিশেষ অসুখে গ্রামের পর গ্রাম আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ’। এক সময় প্লেগ, গুটি বসন্ত, কলেরা রোগের মহামারীর কথা আমরা শুনেছি। ‘মহামারী’ শব্দটার সাথে তাই আমাদের অনেকের মাঝেই এক ধরণের ভীতি জড়িয়ে আছে। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য বিষয়টির এত উন্নতি হয়েছে যে ‘মহামারী’ মানেই সবসময় ভয়াবহ কিছু নয়।

বর্তমানে ‘মহামারী’ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এপিডেমিক’, তার একটা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সংজ্ঞানুযায়ী, জনপদে কোন অসুখ কখনো যদি সুস্পষ্টভাবে ওই সময়ের প্রেক্ষিতে প্রত্যাশার চাইতে বেশী হারে পরিলক্ষিত হয়, তবে তখন সেটাকে ‘মহামারী’ বলে। কোন লোকালয়ে যদি কখনো নতুন রোগের সন্ধান মেলে, তখন অল্প কয়েকজন মানুষ আক্রান্ত হলেই তাকে মহামারী বলা যায়। কারণ, ওই অসুখটি তখন প্রত্যাশিত হারের চেয়ে বেশী মানুষকে আক্রান্ত করেছে। অর্থাৎ, কোন রোগের মহামারী মানেই হাজার-লক্ষ মানুষের আক্রান্ত হতেই হবে এমন কোন কথা নাই।

কোন জনপদে কোন অসুখের মহামারীর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি না, তা বোঝার জন্য অনেকগুলো উপায় আছে। তার মধ্যে একটি হলো, নিয়মিত উপাত্ত সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এছাড়াও মিডিয়ার কল্যানেও অনেক দেশেই মহামারীর খোঁজ পাওয়া যায়, এটা আজকাল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মিডিয়ায় কোন রোগের মহামারী সংক্রান্ত কোন সংবাদ প্রকাশিত হলে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার স্বীকৃত পদ্ধতির মাধ্যমে আসলেই মহামারী চলছে কি না, তা যাচাই করে নিশ্চিত করেন।

দেশে কোন রোগের মহামারী চলছে কি না, সরকারী পর্যায়ে তা নির্ধারণের অন্যতম দায়িত্ব রোগতত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের। এছাড়াও জনস্বাস্থ্য গবেষণা সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা থাকতে পারে। আইইডিসিআর বা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ডেঙ্গু রোগের আগের বছরের উপাত্তগুলো নিশ্চয়ই সংরক্ষিত আছে।

আগের কয়েক বছরের ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যাগুলোর সাথে এবছরে ইতিমধ্যে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের তুলনা করলেই আমরা জানতে পারবো, দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগের মহামারী চলছে কি না। মহামারী নির্ধারণের এটাই স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এই পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে কোন মেয়র প্রমান ছাড়া কেবল পদাধিকারবলে কিছু বললেই তা সত্য হয়ে যায় না, এমন কী তা অধিকাংশ মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয় না।

আমরা অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি, গত বছর আইডিসিআরের কয়েকজন গবেষক একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্ণালে ২০১৩-২০১৬ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকারভেদ (সেরোটাইপ) বিশ্লেষণ করে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন যে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ডেন-ভি ৩ এবং ডেন-ভি ৪ এর প্রাদুর্ভাব দেখা যেতে পারে। তাদের সুনির্দিষ্ট আশংকা থাকা সত্বেও আমাদের দুই সিটি কর্পোরেশন মশক নিধন কর্মসূচি জোরদার করেননি। বরং মশার ওষুধ কেনার নামে তারা হরিলুট করেছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে পৌছেছে, তাতে পূরবর্তী বছরসমূহের উপাত্তের জন্য অপেক্ষা না করেও বলা যায়, ঢাকায় এখন ডেঙ্গুর মহামারী চলছে। চিকিৎসকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযীয়ী, আগের বছরগুলোতে ডেঙ্গুর ডেন-ভি ১ ও ডেন-ভি ২ স্ট্রেইন পাওয়া গেলেও এ বছর রোগীরা ডেন-ভি ৩ দ্বারা বেশী আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ডেন-ভি ৩ এর স্ট্রেইন ডেন-১ ও ২ এর চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতিকর এবং এর লক্ষণগুলোও কিছুটা ভিন্ন। তাই সামান্য জ্বর হলেই এবার রোগীদের চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হবার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। মহামারী নিয়ন্ত্রণেরও স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে।

ঢাকার নগরপিতারা এবং মন্ত্রী মহোদয় কেন ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে খাটো করে দেখছেন, তা বোধগম্য হচ্ছে না। তারা এটা কার কাছ থেকে লুকোতে চাইছেন? দেশবাসী তো তাদের কথা বিশ্বাস করছেন না। এমন কী বিদেশীরাও তাদের মত করে বাস্তব পরিস্থিতি নিয়মিত জানছেন। উট পাখির মত মরুভূমির বালিতে মুখ লুকিয়ে রাখলে সত্য চাপা পড়ে যায় না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, আমেরিকা, এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক দেশেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। তারা তো কেউ বাস্তবতাকে অস্বীকার করছে না। আশির দশকের আগে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গু মহামারী আকারে থাকলেও এখন ১০০র বেশী দেশেই নিয়মিত ডেঙ্গু রোগ হচ্ছে। সেই হিসেবে, বর্তমান পৃথিবীর প্রায় আড়াইশ কোটি মানুষ ডেঙ্গু রোগের ঝুঁকির মধ্য বসবাস করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে পাঁচ থেকে দশ কোটি লোক ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ লোক মারাত্মক ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশই হলো শিশু রোগী। আক্রান্তদের মধ্যে আড়াই শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। এটাই বাস্তবতা।

সুতরাং, উল্টোপাল্টা না বকে যার কাজ তাকে করতে দিন। আইইডিসিআরের উচিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় ডেঙ্গু পরিস্থিতির উপর প্রতিদিন বিশেষ বুলেটিন বের করা, প্রয়োজনে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করা। এবং সিটি কর্পোরেশনের উচিত যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর ওষুধ প্রয়োগ করে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী মশাদের আবাসস্থল ধ্বংস করা। আমরা সবাই জানি, জনগণকে সচেতন করতে হবে ও তাদের বাসা-বাড়ি এবং আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তবে নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা উচিত, কয়েকদিনের মধ্যে মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা সম্ভব হলেও মানুষের আচরণ কিন্তু রাতারাতি বদলানো যায় না। মানুষের আচরণ বদলানো হল অন্যতম কঠিন একটা কাজ। দেরিতে হলেও ডেঙ্গু রোগের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষার ফি কমিয়ে সরকার একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্মিলিতভাবে আমাদের গুরুত্বের সাথে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। শুধু কথায় মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, পরিস্থিতির অবনতি হয় শুধু।

লেখক: অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; চেয়ারম্যান, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেইফটি এন্ড রাইটস।


সর্বশেষ সংবাদ