প্রাথমিকে ঝরে পড়া শূন্যে আনা সম্ভব

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। যা ব্যতীত ব্যাক্তি উন্নয়ন, সমাজের উন্নয়ন,রাষ্ট্রের উন্নয়নসহ যাবতীয় উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। একসময় আমরা নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশ ছিলাম। তা থেকে আমাদের শিক্ষাসহ সকল সূচকে অনেক উন্নতি হয়েছে। যার কারণে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ পেরিয়ে ২০৪১ সালে একটি উন্নত বাংলাদেলের স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব। যার জন্য প্রয়োজন আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা।

আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইজারল্যাল্ডসহ বিশ্বের উন্নতগুলো দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখি প্রত্যেকটি দেশেরই শিক্ষার হার শতভাগ বা তার কাছাকাছি। আর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৯। শতভাগ অর্জনই আমাদের লক্ষ্য। দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুদের বিদ্যালয়ে নীট ভর্তির হার ৯৭.৯৪%। প্রাথমিক শিক্ষাচক্রে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ছে। পিতামাতার অসচেতনতা, দারিদ্র্য, শিশুশ্রম, অশিক্ষা এবং বাল্যবিবাহ এর কারণে শিশুরা শিক্ষার সোপান থেকে ঝরে পড়ছে। এই ঝরে পড়ার হার গত দশ বছরে অর্ধেক কমেছে। এভাবে কমতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তা শূন্যের কোটায় আসবে বলে আমরা আশা করি।

ঝরে পড়ার জন্য যে কারণগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার ধারাবাহিক ব্যাখ্যায় আসি। প্রথমেই রয়েছে অভিভাকদের অসচেতনতা। এটা অনেকটাই নিরসন করা যাচ্ছে মা/অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক,মত বিনিময় সভা কিংবা হোম ভিজিটের মাধ্যমে। এগুলো যত বেশি বেশি করা যাবে অভিভাবকগনের সচেতনতা ততই বৃদ্ধি পাবে।

সরকারের পক্ষ থেকে শতভাগ উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হচ্ছে। এই অর্থ রুপালী ব্যাংক শিওর ক্যাশের মাধ্যমে মায়েদের একাউন্টে চলে যায়। এবং উপবৃত্তি পেতে হলে শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে ৮৫℅ দিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হয়। এবং পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। শতভাগ উপবৃত্তি সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মায়েদের সচেতনতায় শিশুরা মিড ডে মীল নিয়ে ইউনিফর্ম পড়ে শিক্ষা উপকরণ নিয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। আমরা মা সমাবেশসহ প্রতিটি অনুষ্ঠানে অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে থাকি।

এর পরে রয়েছে শিশু শ্রম। এটি একটি মারাত্মক ব্যাধি যা শিশুদের অল্প বয়সেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। শিশুরা অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন মৌসুমে কাজে জড়িয়ে পড়ে। কোন কোন অঞ্চলে শিশুরা মাছ ধরতে জেলের পেশা কিংবা ইটভাটায় ঝুকিপূর্ণ কাজ করে। ইটভাটায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রি হয়ে যায়।আবার কোথাও কোথাও ধান, সয়াবিন,  বাদামসহ মৌসুমী শস্যক্ষেতে কাজ করতে চলে যায়। সরেজমিনে পরিদর্শনে এই সকল চিত্র আমরা পাই। এক্ষেত্রে অভিভাবকগনের উদাসীনতা এবং অতি লোভ চরমভাবে দায়ী। ঝরে পড়া রোধে উদাসীন হলে চলবে না। অভিভাবকগণের সহযোগিতা অনেক বেশি প্রয়োজন।

দারিদ্রতাকে আমরা আস্তে আস্তে বিদায় দিচ্ছি। এটা খুব একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না। আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন।এখন আর কেউ না খেয়ে থাকে না। আমরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম তখন আমাদের সর্বোচ্চ ১ টা কিংবা ২ টা জামা ছিল। এগুলাই আমরা অদল বদল করে গায়ে দিতাম। আর এখন সবারই কম বেশি ৫/৬টা জামা ঘরে থাকে।মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হচ্ছে। দারিদ্রতার কষাঘাত থেকে আমরা ধীরে ধীরে মুক্ত হচ্ছি। এটাও একসময় পুরোপুরি নিবারণ করা সম্ভব হবে।

বাল্যবিবাহের প্রবণতা থেকে এখনও দুর্গম চর অঞ্চলগুলো মুক্ত হতে পারেনি। সরকারের বিধি নিষেধ সত্ত্বেও অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের (বিশেষ করে কন্যা সন্তান) প্রশাসনে অগোচরে গোপনে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বিয়ে দিয়ে দেন। গত কিছুদিন আগেও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সহযোগিতায় ৪র্থ শ্রেণির একজন ছাত্রীর বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আইন সম্পর্কে সচেতন না হলে, আইন না মানলে নিজের ক্ষতি তথা দেশেরও ক্ষতি।এক্ষেত্রেও সরকারকে সহযোগিতার জন্য অভিভাবকগণের সচেতনতা জরুরী।

সরকার শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এখনো প্রাথমিক শিক্ষাচক্রে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ছে। ১ম শ্রেণিতে ২ দশমিক ২ শতাংশ, ২য় শ্রেণিতে ২ দশমিক ৮ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণিতে ২ দশমিক ৯ শতাংশ, চতুর্থ শ্রেণিতে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ঝরে পড়ার হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

ঝরে পড়া রোধে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকাভিত্তিক শিশু জরিপপূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা, নিয়মিত মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও হোম ভিজিট কার্যক্রম, বছরের প্রথম দিন শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ, রূপালী ব্যাংক শিওর ক্যাশের মাধ্যমে শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান, শতভাগ স্কুলে মিড ডে মিল চালু, একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম চালু, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু করা ও উপকরণ সরবরাহ, স্থানীয় জনগণকে বিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা এবং আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।এর সবকয়টিই চালু রয়েছে। আন্তরিকতার সহিত কাজ করে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।

এ মুহুর্তে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবুল কালামের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখ। স্বপ্ন হলো সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।

আমরা স্বপ্ন দেখি উন্নত বাংলাদেশের।এটি বাস্তবে পরিনত হোক তা আমাদের সকলেরই প্রত্যাশা। মানুষ তার প্রত্যাশার সমান বড়। এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার।

লেখক: সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
naforhad.du@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ