ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত হয়েছিলাম যেভাবে

সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শেষে যখন সাংবাদিকতায় আসি তখন বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি নির্দেশ করেছিলেন ক’দিন বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করো। তারপর দেখবো স্টাফ করা যায় কিনা। মনি ভাইয়ের কারণেই কিন্তু সাংবাদিক হয়েছিলাম। না হলে বিলেত প্রবাসী হয়ে যাবার কথা ছিল পরিবারের অন্যদের মতো। মনি ভাই বলতেন সাংবাদিকতা দখল করে রেখেছে পিকিংপন্থিরা। সেখান থেকে মুক্ত করতে হবে ঢাকার সাংবাদিকতাকে। মনি ভাইয়ের ইচ্ছায় সেদিন সাংবাদিকতায় এসেছিলাম। এই মানুষটির কাছে আমি ঋণী, চিরঋণী।

একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন তার দপ্তরে। গিয়ে দেখি ম্যানেজিং এডিটর আনোয়ারুল ইসলাম ববি বসে আছেন। পরে তিনি মর্নিং সানের সম্পাদক হয়েছিলেন। একটু পরেই চলে গেলেন ববি ভাই। কি করছিস? মনি ভাইয়ের বিখ্যাত ডায়লগ। কারো সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই বলতেন কি করা হয়। তোকে ডেকেছি একটি বিশেষ কারণে। একটি রিপোর্ট করতে হবে। সম্পাদক অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছেন সরাসরি। শোনার আগেই শিহরিত। এর মধ্যে ফোন বেজে উঠলো। মনি ভাই ফোন ধরেই বললেন, মাখন তোর সঙ্গে পরে কথা বলবো। এখন একটু ব্যস্ত আছি। মতি, শোন রিপোর্টটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। কি সে রিপোর্ট যে, খোদ সম্পাদককে বলতে হবে। চিফ রিপোর্টার, নিউজ এডিটর বাদ দিয়ে। নিশ্চয়ই বড় কিছু হবে। সিগারেট ধরালেন। পত্রিকার ফাইলের ওপর তখন তার দৃষ্টি। বললেন, রোকেয়া হলের সামনে গিয়েছিস। জ্বি, কেন বলুনতো? চোখে কিছু পড়েনি। অনেক কিছুই তো দেখি। আপনি কোনটার কথা বলতে চাচ্ছেন। দেখছিস নিশ্চয়ই রিকশাওয়ালারা পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। পাশে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে প্রেম করে। দেখেছি, এটাতো নতুন কোন ঘটনা নয়। তোর কাছে খারাপ লাগে না। এটা কি কোন ভদ্র পরিবেশ হলো? এর সঙ্গে নিষিদ্ধ পল্লীর তফাৎটা কি? এটা বদলাতে হবে। তুই একটি রিপোর্ট করবি। বিপদ হলে আমি আছি। সম্পাদকের অ্যাসাইনমেন্ট। না বলার সাহস কোথায়? তাছাড়া, আমার কাছেও বিষয়টি খারাপ লাগতো। কিন্তু ভাবিনি এ নিয়ে রিপোর্ট হতে পারে। ফটোগ্রাফার নিয়ে যাস কিন্তু। সহকর্মী আশরাফ খানকে বললাম দোস্ত কি করি? এই রিপোর্ট লিখলে প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

আশরাফ বললো লিখতে যখন হবে এ নিয়ে চিন্তা করিস না। তিন দিন ওই রিপোর্টের পেছনে ঘুরলাম। রোকেয়া হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই কাজ। বন্ধু ফটোগ্রাফার রফিকুর রহমান। বর্তমানে সে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সে কাজ করে। অনেকগুলো অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললো। রিপোর্ট লিখলাম। অনেক লম্বা রিপোর্ট। হাতে কম্পোজ হতো তখন। চিফ রিপোর্টার বললেন, এই রিপোর্ট কে লিখতে বললো। মনি ভাই বলেছেন। ঠিক আছে। দ্রুত রিপোর্টটি চলে গেল বার্তা সম্পাদকের কাছে। বার্তা সম্পাদক ভাবনায় পড়লেন কি ট্রিটমেন্ট দেবেন। ছবি আছে, রিপোর্টটিও মজাদার। সংবাদপত্রের পরিভাষায় ‘সসি’ রিপোর্ট। তিন কলাম করে দিলেন। সকাল হতে না হতেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। কে লিখেছে এই রিপোর্ট। প্রথম ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারকে ধরো। কাগজ পোড়ানো হলো বেশকিছু। এখানেই শেষ নয়। মিছিল বের হলো। রোকেয়া হলের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকা হলো। ঘোষণা দেয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার আজ থেকে এই এলাকায় অবাঞ্ছিত। যেখানে পাবেন সেখানেই হিট করার ঘোষণাও এলো সমাবেশ থেকে। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছি। অফিসে যেতেও ভয় পাচ্ছি। অনেকটা আত্মগোপনে চলে যেতে হলো। মনি ভাই শুনেই বললেন ওকে সাবধানে থাকতে হবে। ববি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বললাম এই অবস্থায় কি করণীয় আছে। তিনি বললেন, ভাবনার কিছু নেই। মনি একটা কিছু করবে।
আপাতত গা-ঢাকা দিয়ে থাকা প্রয়োজন। আরও ভয় পেয়ে গেলাম। মনি ভাইয়ের সঙ্গে বাসায় দেখা করতে গেলে বললেন, শাবাশ। তোর রিপোর্টে কাজ হয়েছে। দেখছিস না কত প্রতিক্রিয়া। আপনিতো জানেন ওরা আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। ওদের আপত্তির কি হলো এমন। বললাম, ওরা নিষিদ্ধ পল্লীর সঙ্গে তুলনাটাকে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। আমি কথা বলবো ভিসি’র সঙ্গে। তুই চিন্তা করিস না। অফিসে কি যাবো? কেন যাবি না। যদি হামলা চালায়। মগের মুল্লুক নাকি। বলে দিচ্ছি তোর ওপর হামলা হলে দেখিস কি করি? এনিরুল হক চৌধুরীকে বলে দিচ্ছি। ওরা প্রটেকশন দেবে। তুই কি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত এখনও। জ্বি, কেন্দ্রীয় কমিটির গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্বে আছি। তাহলে আর কি? ওরা কি আর করবে। আবেগ থেমে গেলে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যে ছেড়ে দিতে হয়েছে। অসুবিধা নেই। তুই ক’দিন না হয় হোটেলে থাকবি বা কারো বাসায়। আশ্বস্ত হয়ে ক্লাবে ফিরলাম। বন্ধু-বান্ধবরা চিন্তিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন একবার ক্ষেপে গেছে তখন সমূহ বিপদ। ‘জনপদ’-এ কাজ করতো বন্ধু ওবায়দুল হক কামাল। সে বললো দোস্ত আমার বাসায় থাকবি। যা হয় হবে। এভাবেই কেটেছিল বেশকিছু দিন। পরে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে পরিস্থিতি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও জানিয়ে দেন, ভবিষ্যতে যেন আর এ রকম কিছু না ঘটে।
রিপোর্টার থেকে সম্পাদক হয়েছি। বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়েছে। মামলা-মোকদ্দমা এমন কি জেলখাটা থেকে শুরু করে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি। কিন্তু আজও ভুলিনি সে দিনগুলোর কথা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, দৈনিক মানবজমিন

নোট: লেখাটি ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির বার্ষিক স্যুভেনিরে প্রকাশিত হয়েছিল।


সর্বশেষ সংবাদ