বইয়ে আগ্রহ কম, ঢাবি শিক্ষার্থীদের ভরসা নোট-গাইড!

  © ফাইল ফটো

গত শতাব্দীর শুরুতে নাটকীয় সব ঘটনাপ্রবাহ আর নানা হিসাবনিকাশ মিলিয়ে এ অঞ্চলে যাত্রা শুরু হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে বিবেচিত। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের দিক বিবেচনা করলে অবশ্য এটিকে সঠিক বলা চলে, কারণ প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষায় সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয় তীব্র। কিন্তু এর পরের অবস্থাগুলো মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। বিশেষত শিক্ষার মান, গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, ‘এখনকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আগের চেয়েও ভালো, কিন্তু গড় মান কমে গেছে। বেশিরভাগই ভালোভাবে বাংলা ও ইংরেজিও জানে না। আগে বইপত্র পড়ায় আগ্রহ থাকলেও এখন নোট পড়ে পরীক্ষা দেয়।’

হাজারো ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম আর সাফল্যের চিরচেনা বিদ্যাপীঠ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮ বছর পূর্ণ হলো ১ জুলাই। প্রতিবছর এই দিনটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এবারও ছিল বর্ণিল আয়োজন। শোভাযাত্রা, আলোচনা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ আরও অনেক কিছুই। আলোকসজ্জা করা হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলোয়। এতসব আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কারোরই মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের পেছনেই রয়েছে হাজারো হতাশার গল্প। বিশেষত, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা কতটা পূরণ হয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরেন অনেকে।

একটা বিষয় কিন্তু সত্য, প্রথাগত ভাবনার বাইরে দাঁড়িয়ে দেশ ও জাতি গঠনে অবিরত লড়ে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। পরবর্তীকালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশ যখনই কোনো সংকটে পড়েছে, এগিয়ে এসেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদ জানিয়ে দেশকে সংকট থেকে উত্তরণে ভূমিকা রেখেছেন তারা। সর্বশেষ একুশ শতকে এক-এগারোর অগণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত ও গতবছর দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ কিংবা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনেও এ বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সব মিলিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না।

প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কোনো অংশেই কম ছিল না। বিজ্ঞানী সত্যেন বোস, দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব এবং গণিতের তুখোড় শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ইতিহাসবেত্তা মোহর আলী ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো অসংখ্য কৃতীজন এ বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এখনও রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জয়জয়কার; কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়। সর্বশেষ দু-তিন দশকে এই বিশ্ববিদ্যালয় কি একজনও সত্যেন বোস, গোবিন্দ চন্দ্র দেব কিংবা কাজী মোতাহার হোসেন, ড. ইউনূস তৈরি করতে পেরেছে। এর উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান সবারই জবাব হবে ‘না।’

এই জবাব ‘না’ হওয়ার পেছনেও কারণ অনেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন প্রবীণ অধ্যাপক কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ‘আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ শিক্ষক ছিলেন মেধাবী। এখন তা ২০ শতাংশে ঠেকেছে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে যত প্রশ্ন এখন আসে, তার বড় জবাবই হয়তো স্যারের এই কথার মধ্যে নিহিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বড় অংশ নিয়েই প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিশেষত রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। শিক্ষক যদি যোগ্য না হন, তাহলে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাবেন না, এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবেও হয়তো সেটাই হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এ কথার ক্ষেত্রে তেমন দ্বিমত করতে পারব না।

জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘মাস্টোররা জ্ঞানে, আনন্দে ও জাতি গঠনে নিজেদের নিবেদন করেছিলেন বলে আজও এ ক্যাম্পাস জাতির অহঙ্কারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’ অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ আজ রাজনীতিকে রাখেন পছন্দের শীর্ষে। দলীয় পদ নিতেও দ্বিধা করেন না। ভালো গবেষণার খবর পাওয়া যায় কালে-ভদ্রে। গবেষণা কিংবা নিয়মিত ক্লাস বাদ দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সান্ধ্যকালীন কোর্সে ক্লাস নিতে আগ্রহ বেশি অনেকের। এক্ষেত্রে বাড়তি উপার্জনের মতো কিছু ব্যাপারও থাকে। সাদা, নীল ও গোলাপিতে ভাগ হয়ে গেছেন শিক্ষকরা। তাদের এই ভাগাভাগিতে অনেক সময় দিশা খুঁজে পান না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অবশ্য এর মধ্যেও এখনও অনেক ভালো শিক্ষক আছেন, যাদের হাত ধরেই ধীরে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। তবে তাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যার ভূমিকা তুলনারহিত, তিনি নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। অথচ তার মূল্যায়ন এখন যৎসামান্যই হতে দেখা যায়। এমনকি তার জন্ম কিংবা মৃত্যুদিবসও স্মরণ করে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু তার স্মৃতি ধারণ করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সলিমুল্লাহ মুসলিম (হল)। ওই হলের কর্মচারীরাই শুধু তার স্মরণে দোয়ার আয়োজন করে থাকেন প্রতিবছর। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল তাকে সম্মানের শীর্ষস্থানে ধারণ করা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, কার্জন হল, অপরাজেয় বাংলা, মধুর ক্যান্টিন, ডাকসু ও কলাভবন চত্বর ঘিরে সেই সময়কার বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে। তবে টিএসসিকে অতীতে সংস্কৃতিচর্চার তীর্থভূমি বলা হলেও এখন তা কতটা হয়, সেটা নিয়ে প্রশ্ন অনেক। অথচ প্রিয় ক্যাম্পাসে গুলি ও ককটেলের শব্দের চেয়ে বেশি ছিল সংস্কৃতির শক্তি। আসকার ইবনে শাইখ, ফেরদৌসী মজুমদার ও আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো মুখগুলো ছিল পরিচিত।

১৯২১ সালের ১ জুলাই ছাত্রছাত্রীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উম্মুক্ত হয়। সে সময় ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয় বলে জানা যায়। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষকসংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট এবং ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রায় ৩৭ হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন এক হাজার ৯৯২ জন। ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্যে রয়েছে ২০টি আবাসিক হল ও তিনটি হোস্টেল। তবে প্রথমে সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা করলেও পরে আর সে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

এই আবাসন নিয়েই এখন সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট, দুঃখ আর হতাশা। ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর অর্ধেকের জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা নেই। যেটুকু ব্যবস্থা আছে, তা নিয়েও শিক্ষার্থীদের রীতিমতো সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। হল কর্তৃপক্ষ নয়, সিটে শিক্ষার্থী ওঠান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা। এজন্য সর্বপ্রথম তাদের সঙ্গে লবিং করার পাশাপাশি গেস্টরুমের মতো নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়। সেটিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রথমে মেলে হয় গণরুম নয়তো হলের বারান্দা। পরে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ‘বড়ভাই’দের মন পাওয়ার প্রতিযোগিতা। যে এটা ভালোভাবে করতে পারবে, তার রুমের সিটও মিলবে আগে। এটিই এখন হলগুলোতে সিট পাওয়ার অঘোষিত নিয়ম।

এই গণরুমের বারান্দায় থাকতে গিয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাও ঘটেছে অনেক। অনেক চেষ্টার পর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বারন্দায় স্থান হয়েছিল মেধাবী ছাত্র হাফিজুর রহমানের। তবে শীতের ধকল সইতে না পেরে নিউমোনিয়া ও টাউফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার। ওই হলেই একবার ৯৭ ছাত্রকে মধ্যরাতে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তার পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সব হলেই খোঁজ নিলে হয়তো এমন করুণ অনেক ঘটনাই সামনে আসবে।

গৌরবের ক্যাম্পাসে চলতি বছরই যুক্ত হয়েছে নতুন পালক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) দীর্ঘ ২৮ বছর পর নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে। প্রায় তিন দশক পর সিনেট পেয়েছে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি। অবশ্য ডাকসু নির্বাচন ও ছাত্র প্রতিনিধি বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছে অনেক। এ নিয়ে সংঘর্ষ, হামলা-মামলা, রাজনৈতিক খেল অনেক কিছুই হয়েছে। খোদ নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরও ডাকসু নির্বাচন ও ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। এই ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষেই ছাত্রদলও দীর্ঘদিন পর ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ পেয়েছে, এখনও আছে। সব মিলিয়ে এখন হয়তো অনেকেই একটু সন্তোষ খোঁজেন হাজারো না পাওয়ার ভিড়ে কিছু হলেও তো মিলেছে! রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও ডাকসু সচল, সিনেটেও প্রতিনিধি রয়েছে। যদিও সাধারণ ছাত্রদের প্রত্যাশা ডাকসু ও ছাত্র প্রতিনিধিরা কতটা পূরণ করতে পারছেন তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন রয়েই গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আরও অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। হলে ছাত্র রাজনীতির কর্তৃত্ব। খাবারের মান দিন দিন যেন খারাপই হচ্ছে। পর্যাপ্ত ক্লাসরুমের অভাব। লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিট মেলে না। সান্ধ্যকালীন কোর্স আর সাত কলেজ নিয়ে অসন্তোষের শেষ নেই। শিক্ষার মান নিয়ে তো নতুন করে আর কিছু বলার নেই। র‌্যাংকিংয়ে নাম না থাকা বা অনেক পিছিয়ে থাকা নিয়ে এ বছরও একরাশ বিতর্ক হয়ে গেছে। রেজিস্ট্রার ভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতাও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির বড় কারণ। বহিরাগত গাড়ির কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হাঁটা দায় হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে যাওয়া মেট্রোরেল নিয়েও অসন্তোষ কম নয়। এমন হাজারো সমস্যা আর সংকটে জর্জরিত এ বিশ্ববিদ্যালয়।

এরপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কার্জন হল থেকে অপরাজেয় বাংলা, টিএসসি থেকে মল চত্বর, ভিসি চত্বর, মধুর ক্যান্টিন, হাকিম চত্বর পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে নানা স্মৃতি রেখে গেছেন পুরোনোরা। এখনও রাখছেন, নতুনরা আসছেন। পুরোনোরা স্মৃতিচারণ করছেন, আর নতুনরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় অতীত ইতিহাস জানছেন। প্রাণের ক্যাম্পাস কারও কাছে স্মৃতি আর কারও কাছে বর্তমান হলেও সবার চোখেই গৌরবোজ্জ্বল। জাতীয় অধ্যাপক (মরহুম) কবীর চৌধুরী স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে তার পাশের একটি কক্ষে পাঁচ মিনিট কথা বলা যেত।’ এর মধ্যেও প্রেম হতো। তবে এখন প্রেম-ভালোবাসার ক্যাম্পাসে পরিবর্তন এসেছে অনেক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রয়াত অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিঞা একবার বলেছিলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপমা বিশ্বে কেবল এ বিশ্ববিদ্যালয়ই হতে পারে। অন্য কারো সাথে এর তুলনা হয় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে কখনো বিশ্বে এত বড় অর্জন হয়নি কোনো দেশের।’ আসলেই তা-ই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের যত ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গৌরব তা কখনও শেষ হওয়ার নয়। অতীতে গৌরবের এই ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির হাত ধরে অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখা গেছে। শোনা গেছে, গুলি-ককটেলের শব্দ। তবে এখন তা অনেক কমেছে এটিই আশার কথা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসে গৌরব ক্ষণিকের জন্য মলিন হয়েছে ঠিকই, তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। মেঘ আসবে। তাই বলে নক্ষত্র ঢেকে থাকবে না। তা-ই হয়েছে।’ ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস এখন প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। সাবেকদের অনেকে মনে করেন, আগে এত জাঁকজমক না থাকলেও ভালো ফল ছিল। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ ও প্রথম শ্রেণি কম থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মেধাবীদের, ভালো শিক্ষকদের। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। অনেক শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দূরত্বও বেড়েছে অনেক। প্রায়ই বেফাঁস মন্তব্য আসে শিক্ষকদের দিক থেকে। শিক্ষার্থীরাও কম যান না। রাজনীতিও এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যে অন্যতম বাধা।

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত দেশি-বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ হতো রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। ছয় মাস পারফরম্যান্স বিবেচনা করে স্থায়ী করা হতো। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার পাশাপাশি শিক্ষার প্রতি তার অনুরাগ বিবেচনা করা হতো। সরকার নিয়োগ দিলেও রাজনৈতিক বিবেচনা স্থান পেত না। তবে সত্তরের দশক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমা শুরু হয়।’ স্যারের এ কয়েকটি কথার মধ্যেই হাজারো প্রশ্নের উত্তর। তার কথার সূত্র ধরেই বলতে চাই সব বাধার দেয়াল ভেঙে আবারও ক্যাম্পাস হয়ে উঠবে মেধাবী ছাত্রদের, ভালো শিক্ষকদের। ২০২১ সালে শতবর্ষ উৎসব উদ্যাপনের আগেই সব সংকট কাটিয়ে উঠুক প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেটাই এখন প্রত্যাশা।

গণমাধ্যমকর্মী
touhiddu.rahman1@gmail.com

 


সর্বশেষ সংবাদ