স্মৃতির ডায়রীতে সুফিয়া কামাল

বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা।যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙালি মুসলিম নারীদের গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হত। সুফিয়া কামালের শিশুমনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলো বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সম্প্রতি বেগম সুফিয়া কামালের ১০৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ ডুডল প্রদর্শন করেছে সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল।

জন্ম
১৯১১ সালের (১৩১৮ বঙ্গাব্দ) ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন।

বংশ পরিচয়
বেগম রোকেয়ার বাবার নাম সৈয়দ আব্দুল বারী। তিনি কুমিল্লার বাসিন্দা ও পেশায় উকিল ছিলেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়ার যখন ৭ বছর বয়স তখন তিনি সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। তাঁর মাতার নাম সৈয়দা সাবেরা খাতুন। তিনি বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের মেয়ে ছিলন। সাবেরা খাতুন স্বামীর নিরুদ্দেশের পর অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন ও সুফিয়া কামালকে লালন পালন করেন।

বিবাহ ও সংসার জীবন
মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৯২৪ সালে সুফিয়া কামালকে বিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ১ম স্বামীছিলেন মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেন। তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজ সেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। ১৯৩২ সালে তার আকস্মিক মৃত্যু হয়। ১ম স্বামীর মৃত্যুর পর সুফিয়া কামাল ১৯৩৯ সালে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই থেকে তার নামের পশ্চাতে কামাল যোগ হয়ে সুফিয়া কামাল নাম হয়। তাঁ তিনটি মেয়ে আছে। তারা হলেন- আমেনা আক্তার(১ম পক্ষের), সুলতানা কামাল, সাঈদা কামাল এবং দুই ছেলে:- শাহেদ কামাল, সাজেদ কামাল।

শিক্ষা জীবন
যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম হয় তখন বাঙালি মুসলিম নারীদের গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হত। মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। মুসলিম মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল একেবারেই পিছিয়ে তখন সুফিয়া কামালের মতো স্বশিক্ষিত ও সমাজপ্রগতি-সচেতন নারীর আবির্ভাব ছিল এক অসাধারণ ব্যাপার। শায়েস্তাবাদে নানার বাড়ির রক্ষণশীল অভিজাত পরিবেশে বড় হলেও সুফিয়া কামালের মন ও মনন গঠনে দেশ, দেশের মানুষ ও সমাজ এবং ভাষা ও সংস্কৃতি মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বাংলা শেখেন মূলত তাঁর মায়ের সহযোগিতায়। বাড়িতে উর্দুভাষার প্রচলন থাকলেও নানাবাড়িতে তাঁর বড় মামার একটি বিরাট গ্রন্থাগার ছিল। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর।

শিক্ষকতা
সুফিয়া কামাল কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৩৩-১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন।

বেগম রোকেয়ার সাথে সাক্ষাৎ
১৯১৮ সালে সুফিয়া মায়ের সঙ্গে কলকাতা গেলে সেখানে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) এর সঙ্গে সুফিয়া কামালের সাক্ষাৎ হয়। কিছুদিন পরে তিনি নানাবাড়িতে ফিরে আসলেও তাঁর শিশুমনে রোকেয়া-দর্শনের সেই স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকে। যা পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্য রচনায় অনুপ্রাণিত করে।

সাহিত্যচর্চার সূচনা
১৯২৩ সালে যে বছর সুফিয়া কামালের বিয়ে হয় সেই বছরেই তাঁর রচিত প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’ বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতা 'বাসন্তী' তখনকার প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়।
১৯৩৭ সালে তাঁর গল্পের সংকলন কেয়ার কাঁটা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়ার মুখবন্ধ লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম।

কাব্যগ্রন্থ
কাব্যগ্রন্থসমূহ যথাক্রমে সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), প্রশস্তি ও প্রার্থনা (১৯৫৮), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দিওয়ান (১৯৬৬), অভিযাত্রিক (১৯৬৯), মৃত্তিকার ঘ্রাণ (১৯৭০) এবং মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২)। গল্পগ্রন্থ: সুফিয়া কামালের গল্পগ্রন্থ কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭)। ভ্রমনকাহিনি: সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮)। স্মৃতিকথাঃ একাত্তরের ডায়েরি (১৯৮৯)। আত্মজীবনীমূলক রচনা: একালে আমাদের কাল (১৯৮৮)। শিশুতোষ গ্রন্থ: ইতল বিতল (১৯৬৫)। নওল কিশোরের দরবারে (১৯৮১)। অনুবাদ: সাঁঝের মায়া - বলশেভনী সুমের্কী (রুশ) (১৯৮৪)।

আন্দোলন-সংগ্রাম
ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। সুফিয়া, তাঁর স্বামী ও ছেলে দেশের মধ্যেই থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও সাহস যোগান এবং মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্ন খবরাখবর সরবরাহের করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী তিনিই জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কার্ফ্যু উপেক্ষা করে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা
যুদ্ধকালীন সুফিয়া কামাল একাত্তরের ডায়েরী নামে একটি দিনলিপি রচনা করেন। তাঁর লেখা কবিতাগুলো পরবর্তীকালে মোর যাদুদের সমাধি ’পরে নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলোতে বাঙালিদের ওপর পাকবাহিনীর নৃশংসতা বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া '‘বেণীবিন্যাস সময় তো আর নেই’' কবিতায় মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি মহিলাদেরও আহবান জানিয়েছেন।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
সুফিয়া কামাল তাঁর পরিবারসহ ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এবছরেই তিনি ছায়ানটের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা
কাব্য, গল্প, অনুবাদ, প্রবন্ধ প্রভৃতি সাহিত্য রচনার জন্য সুফিয়া কামাল ৫০টির অধিক পুরস্কার ও সন্মাননা অর্জন করেছেন। তন্মধ্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), সংগ্রামী নারী পুরস্কার, চেকোশ্লোভাকিয়া (১৯৮১), মুক্তধারা পুরস্কার (১৯৮২),বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল (১৯৯৬),স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯৭) ইত্যাদি।

বাংলা একাডেমীর উদ্যোগ
নারীবাদী লেখিকা সুফিয়া কামালের রচনা সংরক্ষণের জন্য ২০০১ সালে বাংলা একাডেমী তাঁর কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে Mother of Pearls and Other Poems এবং ২০০২ সালে সুফিয়া কামালের রচনা সমগ্র প্রকাশ করেছে।

মৃত্যু
এই মহীয়সী লেখিকা, ভাষা সৈনিক, নারী জাগরণের পথিকৃত সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের (১৪০৬ বঙ্গাব্দ) ২০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।

লেখক: মো. ইকবাল হোসেন
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।