শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে এবারের বাজেটের ভূমিকা

  © ফাইল ফটো

শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য ইতিবাচক হলেও শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ অদ্যবধি নেওয়া হয়নি। প্রতিবছর বাজেট পেশ হয় শিক্ষাখাতে অর্থ ব্যয় হয়, কিন্তু প্রত্যাশিত অর্জন এখনো আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সুশিক্ষিত জাতি তৈরি ও উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। বর্তমানের বাজেট কতটুকু শিক্ষা সহায়ক তা নিয়ে আজকের আলোচনা।

আট বছর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ছিল এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার। যেখানে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেটের শিক্ষা বাজেটে মোট ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এটা জিডিপির তিন দশমিক চার শতাংশ। এটি এখন পর্যন্ত বাজেটে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ।।

যদিও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল জাতীয় বাজেটের ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এদুটো বাজেট বাদে বিগত বছরের অধিকাংশ বাজেট তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব সময়ই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই চলে যায় বেতন–ভাতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতে। মোট বাজেটে অর্থ বাড়ায় শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দও বেড়েছে। কিন্তু বরাদ্দের হার সেভাবে বাড়েনি। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকেও ভালো অবস্থানে নেই শিক্ষা খাতের বাজেট।

কয়েক বছর ধরে জিডিপির দুই থেকে তিন শতাংশের কাছাকাছি থাকছে শিক্ষার বরাদ্দ।। তবে আশার কথা হলো, এবার জিডিপির তিন দশমিক চার শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদিও জিডিপি বরাদ্দ চার শতাংশ করার দাবী অনেক দিন ধরে বিজ্ঞ মহলের।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর হিসাব বলছে, শিক্ষাখাতে বাংলাদেশ তার জিডিপির যে অংশ ব্যয় করছে, তা দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। সরকারি এই সংস্থাটির ২০১৬-১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারত ৩.০৮ শতাংশ, পাকিস্তান ২.৭৬ শতাংশ, আফগানিস্তান ৩.৯৩ শতাংশ, মালদ্বীপ ৪.২৫ শতাংশ, নেপাল ৫.১০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২.৮১ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছিল।

দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষা খাতের বরাদ্দের হার বাড়ানোর দাবি থাকলেও তা খুব একটা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ফলে গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) চাহিদা হলো, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হবে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ছয় শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ দূরে অবস্থান করছে।

শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কম বরাদ্দ দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বে অন্যতম বাংলাদেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এ খাতে বাংলাদেশের ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তানও জনগুরুত্বপূর্ণ খাতটিতে বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয়। এমনকি আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত কেনিয়া জাতীয় বাজেটের ৩১% এবং সেনেগাল ৪০% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখে।

দেশে সংখ্যার দিক দিয়ে শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু গুণগত মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে কাজ করতে হবে। এবার বাজেট বক্তৃতায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় মানসম্মত শিক্ষার বিষয়ে। এ বিষয়ে জাপানের সম্রাট মেইজির শিক্ষা সংস্কারের উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে, মেইজির সময়ে জাপান শিক্ষায় অনগ্রসর ছিল। তাই মেইজি প্রযুক্তি নির্ভর প্রশিক্ষিত কয়েক হাজার শিক্ষককে জাপান নিয়ে আসেন। ফলে জাপান জ্ঞান বিজ্ঞান অগ্রসর ও উন্নত হয়। ফলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোকেও জাপান ছাড়িয়ে যায়। যদিও বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা নিয়ে ফেসবুকে চলছে কঠোর সমালোচনা। এটি কতটুকু কার্যকর ও ফলদায়ক হবে তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে।

আমরা বাজেটে যে কয়টি টাকা বরাদ্দ দেখি তা যৎ সামান্য বটে। বাজেটে শিক্ষায় যে বরাদ্দ দেওয়া হবে তার বড় অংশই ব্যয় হয় বেতন-ভাতা ও ভবন নির্মাণে। শিক্ষার উপকরণ কেনা, ল্যাব নির্মাণে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা অর্থাভাবে আনুতোষিকের টাকা পাচ্ছেন না। শিক্ষার গুণগত মান ও পরিধি বাড়াতে প্রয়োজন আশু উদ্যোগ।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত শিক্ষা বাজেটে উপযুক্ত শিক্ষক বাছাই ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে শ্রেণিকক্ষ তৈরি করার বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ন্যানো টেকনোলজি, রোবটিক্স, ব্লক চেইন ম্যানেজমেন্ট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিষয়েরও অবতারণা করা হয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণে ‘ডিজিটাল প্রাথমিক শিক্ষা’ নামে একটি পাইলট প্রকল্পের কথা জানানো হয়েছে। এতে ৫০৩টি মডেল বিদ্যালয়ে ইন্টার‍্যাক্টিভ ক্লাসরুম তৈরি করা হবে।

বাজেটে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন, নতুন জাতীয়কৃত ও বিদ্যমান বিদ্যালয়গুলোতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে পাঁচ বছর মেয়াদী শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রস্তাব করা হয় যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।

এবারের বাজেটে মাদ্রাসার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় এ বছর সর্বোচ্চ সাত হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল পাঁচ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। এই অর্থ মাদ্রাসায় অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বৈষম্য দূরে ব্যবহারে ব্যয় হবে। যা মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে শিক্ষাবীদদের ধারণা।

কারিগরি শিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল তৈরির প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে দুই হাজার ২৮১ কোটি টাকা ৬৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১০০টি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুলের প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে চারটি বিভাগীয় শহর সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুরে মহিলা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।

সবদিক বিবেচনায়, গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সময়োপযোগী পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক তৈরি, উচ্চশিক্ষায় মানসম্পন্ন গবেষণা পরিচালনা- এসব নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা ক্ষেত্রের সকল পর্যায়ে পর্যাপ্ত বাজেট রাখা অনস্বীকার্য।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ