আড়ং, বদলি এবং আমার বাবা (দ্বিতীয় পর্ব)

এক যুগেরও বেশি সময় মামলা চলার পর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আব্বা চাকরি ফেরত পেলেন। কিন্তু উনাকে এক পোস্ট ডিমোশন দিয়ে সেই চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টেই জয়েন করতে বলা হল। রি জয়েনিং লেটারে আচমকা এই ধাক্কায় মামলা জেতার অসাধারণ আনন্দ নিমিষেই ফিকে হয়ে এল। আব্বা কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। দেখা করতে গেলেন হাইকোর্ট বিভাগের সেই শুভকাঙখী রেজিস্ট্রার এর সাথে। সেই ভদ্রলোক বললেন, চাকরি ফেরত পেতেই আপনার লাগলো ১২ বছর। আবার মামলা করলে আরো ১২ বছর লাগবে। আপনি আগে জয়েন করেন। আব্বা চাকরিতে জয়েন করলেন চট্টগ্রামে।

আমরা রংপুর শহরে থেকে গেলাম। কিন্তু চাকরিতে জয়েন করলেও মাস শেষে আব্বার বেতন হল না। খোঁজ নিলেন। পে সেকশন বললঃ আপনার বেতন কত হবে, সেটার গণনা চলছে। সেই গণনা চলতেই লাগলো। ১২ বছরের পাওনা পরিশোধ করা দূরের কথা, রানিং বেতনও আব্বাকে দিচ্ছিল না তাঁরা। আমাদের টাকা পাঠানো দূরের কথা, নিজের চলার টাকাই নাই বাবার। তখনো পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়নি। বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িতে শান্তি বাহিনীর ব্যাপক প্রতাপ।

সেনা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত কাউকে পেলে শান্তি বাহিনী কিডন্যাপ করে। মুক্তিপন নেয় বা মেরে ফেলে। পাহাড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব খারাপ। জীবনের রিস্ক নিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে অডিটে যেতে হয়। তাই পার্বত্য অঞ্চলে অডিটের টিএ ডিএ বেশ ভাল। টাকাটাও নগদ। আব্বা নির্ভরশীল হলেন অই অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে অডিট এর ওপর।

আব্বা ছুটি পেলে রংপুরে আসেন। আমরা বগালেকের গল্প শুনি, আলী কদমের গল্প শুনি, বিলাইছড়ির গল্প শুনি। পাহাড়ের গল্প শুনি। শান্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার গল্প শুনি। আব্বা আসার সময় পুরাতন পত্রিকাগুলা ব্যাগ ভরে আনতেন। ৯৩ সালেই তাই আমি হাতে পাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকা পূর্বকোন।

এছাড়া সুগন্ধা, যায় যায় দিন এরকম বেশ কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা থাকতো আব্বার ব্যাগে। আমাদের আর কিছু চাইনা। মাঝে মধ্যে আসার পথে ঢাকার গুলিস্তান থেকে সস্তার কিছু কাপড়। আমরা তাতেই খুশি। অন্তত আব্বা চাকরি ফেরত পেয়েছে তো। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। আব্বার ওপর সেই মাফিয়া গোষ্ঠীর রাগ পরে না। আব্বা চাকরি করে যান, বেতন পান না। তাঁর ব্যাচমেট অনেকেই তখন উপপরিচালক। তাঁরা আশ্বাস দেয়, কিছুই হয়না।

বাসা রংপুর, আমরা রংপুরে পড়ি, আম্মার চাকরি রংপুর... এসব দেখিয়ে ১৯৯৬ সালে আব্বা রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ট্রান্সফার নিতে সক্ষম হন। এর মধ্যে দেশে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। জাসদের আসম রব ঐক্যমতের সরকারে সমর্থন দিয়ে পশুমন্ত্রী। জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন যোগাযোগ। দীর্ঘ দিন পর বাতিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি। আব্বা আশাবাদী হন।

এবার বঙ্গবন্ধুর দল ক্ষমতায়, এবার অন্তত প্রশাসনের হারামি লোকগুলো সাইজ হয়ে যাবে। কিন্তু না। কিছুই হয়না! বছরের পর বছর যায়, আব্বার বেতন নির্ধারণ শেষ হয়না। আমার বাবা আবার ঢাকায় যান অফিসের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সুপ্রিমকোর্টের রায় বাস্তবায়ন না করার মামলা। প্রশাসনিক ট্রাইবুনালে এই মামলায় আব্বা আর উকিল দিলেন না (আগের অভিজ্ঞতা -উকিলরা ভয় বা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যেতে পারেন)…। শুনানি শুরু হল।

আব্বা নিজেই নিজের মামলা লড়ছেন। জজসাহেব আব্বার সার্ভিস রেকর্ডের সব কপি (১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯৯) চেয়ে বসলেন! এই কাগজগুলো সংগ্রহ সোজা ছিল না। আব্বা বললেন, এটা বাস্তবায়ন মামলা; এখানে পুরাতন কাগজের দরকার নেই। সুপ্রিম কোর্টের রায় বাস্তবায়ন হয়েছে কি না এটুকু দেখলেই হবে। কোর্ট বলল, পুরাতন সব কাগজ না হলে শুনানি করবেন না।

আব্বা ভেবে বসলেন, তাহলে আদালতও কি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। পুরা ডিপার্টমেন্টে গোপন শত্রু/প্রকাশ্য শত্রু। এই কাগজগুলো যোগাড় কঠিন হলেও, সম্ভব হল। তবে সময় গেল অনেক। কোর্ট সব কাগজ নিল, শুনানির কয়েক ডেট পরে, কোর্ট একদিন আব্বাকে বললঃ আপনি উকিল নিয়োগ করেন। আব্বা আদালতে বললেন, তাঁর উকিল নিয়োগের মত আর্থিক অবস্থা নেই। এবং অতীতের অভিজ্ঞতা আইনজীবীদের কিনে ফেলে ব্যুরোক্র্যাটরা, তাই কোনো ভাবেই আব্বা অন্য আইনজীবী দিতে চাচ্ছিলেন না।

জজ সাহেব গোঁয়ারের মত বলে বসলেন, আইনজীবী নিয়োগ না করলে আব্বার কাছ থেকে শুনবেন না। আব্বা বাধ্য হয়ে একজন আইনজীবী নিলেন। এরপর কার্যদিবসে খুব শর্ট হিয়ারিং হল। আইনজীবী শুধু বললেন, এই কেস.. অমুক অমুক নম্বর কেসের মতো। কোর্ট যেন সদয় বিবেচনা করেন। আব্বা বুঝলেন না কিছুই। রায়ের তারিখ হয়ে গেল। অই আদলত এই এক লাইনের শর্ট হেয়ারিং এর ওপর ভিত্তি করে যে রায় দিয়েছিলেন, সেটা কয়েকশ পৃষ্ঠার!

আমি ততদিনে কলেজে পড়ি। কোর্টের রায় উল্টিয়ে পড়ে বোঝার চেষ্টা করি। বিশাল রায়ে কোর্ট বলেছেনঃ আব্বা কবে কিভাবে চকরিতে ঢুকলেন। কিভাবে কোনো অজানা কারণে আব্বাকে বার বার বদলি করা হল হঠাৎ। দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করলে সৎ সরকারি কর্মচারীদের জীবনে কি হেনস্তা হয়, আমার আব্বা সেটার জলন্ত উদাহরণ। এই মামলা খুবই সরল৷

সুপ্রিমকোর্টের রায় মানতে ডিপার্টমেন্ট বাধ্য। বেতন নির্ধারণে কয়েক মিনিট সময় লাগবে। এটা নিয়ে ফাজলামোর সুযোগ নেই। এবং আব্বাকে ডিমোশন দেবার কোনো সুযোগ নেই। আব্বা রায় পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। বুঝলেন জজ সাহেব কেন সব কাগজ দেবার জন্য জেদ করেছিলেন। আসলে অই এক রায়ে আব্বার লড়াই সংগ্রাম, চাকরির সব, এবং তাঁর প্রতি অবিচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আব্বা লড়াই সব এসেছে অই বিশাল রায়ে। এবং উকিল দিতে জোর করেছিলেন জজ সাহেব, কারণ আব্বা হেয়ারিং এ অনেক কথা বলেছেন, যেগুলো টু দি পয়েন্ট ছিল না।

এই কেসে জাস্ট অই রেফারেন্স হলেই চলে। আব্বাকে ঠেকাতে রায়ের ফাইল নিয়ে কুত্তা পাগল দশায় তখন ব্যুরোক্র্যাট মাফিয়ারা। তাঁদের কাছে তখন এটা হয়ে উঠেছে প্রেস্টিজ ইস্যু। ততদিনে, বিএনপি-জামায়াতের জোট ক্ষমতায়। নিজামী তখন মন্ত্রী। আইন মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ নিজেই অই ফাইলের ওপর লিখলেন, নো স্কোপ টু আপিল। অই বদরাগী সদয় জজ সাহেব এমনভাবে রায় লিখেছেন, অটার বিরুদ্ধে আপিলের কোনো সুযোগ খুঁজে পেলেন না তিনিও। ডিপার্টমেন্ট এবার অন্য খেলা শুরু করল। আব্বাকে চিঠি দিল, যে এত তারিখে আপনি রংপুর ক্যান্টনমেন্টের এল ও অফিসের সুপারভাইজারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি ছিনতাই করেছেন। কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।

আব্বা চিঠির জবাবে লিখলেনঃ কি বিষয়ক কগজ ছিনতাই করেছি, জানালে তারপর এই কারণ দর্শাও এর জবাব দেবেন। আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কি? আব্বা বললেন, ঘটনা সত্য। তোর অমুক চাচাকে ধাক্কা মেরে আমি কিছু কাগজ আনছি। -কিসের কাগজ? -একবছরের ঘুষের হিসেব। এরা খুব শৃংখলিত। কোন প্রজেক্টের কত টাকা মারা হচ্ছে। কোন র‍্যাংকের কার কাছে কত ঘুষ যাচ্ছে, তার একটা গোপন লিখিত হিসেব থাকে। আমি সেরকমই একটা গোপন কাগজ ছিনতাই করেছি! এটা সরকারি কাগজ না। তাই আমার চিঠির জবাব ওরা দেবে না। হলোও তাই। ডিপাডিপার্টমেন্ট আর কথা বাড়ায়নি, অই কাগজ নিয়ে।

আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এই কাগজ দিয়ে কি করবেন? আব্বা বলল, এটা আমার জীবন বীমা। মামলা হেরে যাওয়াটা ওরা মানতে পারবে না। কোনোভাবেই যেহেতু পারেনি, এরপর ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু এখন ওরা জানে, আমি মারা গেলে, ঘুষের এই দাপ্তরিক হিসেব সব খানে চলে যাবে। তাই আমাকে মেনে নিতে না পারলেও ফিজিক্যালি মেরে ফেলবে না। কোর্টের রায়ের পর আব্বা বেতন পেতে শুরু করলেন দুই যুগ পর। পুরাতন পাওনার হিসেব চলছে তখনো।

আব্বা নিজের দুই যুগ আগের ডেজিগনেশন ফেরত পেয়েছেন। যদিও তার ব্যাচমেট সবাই অনেক কয়বার পদোন্নতি পেয়েছেন। সবাই রিটায়ার্ড করবেন বা করছেন। আব্বারও চাকরি আছে আর এক/দুই বছর। আমি ততদিনে রংপুর ছেড়ে ঢাকায়। এরকম সময় আব্বাকে বদলি করা হল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এ। করা হল পেনশন সেকশনের ইনচার্জ। আব্বা জয়েন করলেন। এবং সেইদিনই ছুটির দরখাস্ত দিলেন মেডিকেল সার্টিফিকেটসহ। আব্বার প্রেশার তখন থাকতো ২২০/১৪০, কখনো ২৪০/১৬০ এরকম।

চিকিৎসকরা ফুল বেড রেস্ট বললেও আমার অদম্য বাপকে আমরা থামাতে পারতাম না। সেই দুই চকার মান্ধাতার আমলের বাই সাইকেল চালিয়ে তখনো আব্বা গ্রামের বাসা কুড়িগ্রামে যান প্রায়। সেই লোক মেডিকেল লিভ নিল? কেন? আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন? আব্বার উত্তরঃ সারাজীবন লড়াই করলাম দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কোনোভাবেই এত বাঘা বাঘা শক্তি পেরে উঠল না। এবার তাঁরা শেষ কামড় দেবে, এজন্যই আমাকে পেনশন সেকশনের ইনচার্জ করছে। এই সেকশনে সবার সার্ভিস ফাইল থাকে। কিছু ফাইল গায়েব হবে, এবং দোষ পড়বে আমার বাবার ওপর। বলবে ঘুষের জন্য ফাইল গায়েব।

সারা জীবনের ফাইটারের গায়ে কাঁদা ছোড়া হবে। - তাহলে? আব্বা জানালেন তিনি অবসরের জন্য চিঠি দিয়েছেন। আব্বার অগুনতি দিন ছুটি পাওনা আছে। তাই একমাসের ছুটি দিতে তাঁরা বাধ্য। তারমধ্যে, সত্যিকারের মেডিকেল সার্টিফিকেট। অনস্পট প্রেশার মাপলেও, ডাক্তার বলবেন শুইয়া পড়েন এখুনি। আর এই একমাসের মধ্যে অবসরের চিঠি অটো কার্যকর হয়ে যাবে, নিয়মানুযায়ী।

একমাস পর সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আব্বা অবসরে গেলেন ২০০৫ এ। তখনো পুরাতন পাওনা সব পাননি। সে সবের জন্য আব্বাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আসতে হয়। আমি ইউনিভার্সিটি হল থেকে আব্বার সঙ্গী হই। পে সেকশন, লগ এরিয়া, আর সেগুনবাগিচায় ১২ তলা প্রায়ই যাই। সব খানেই আব্বা একটা মিথ। কোনো সেকশনে আব্বা ঢুকলে সবাই উঠে দাঁড়ায়।

র‍্যাংকের কারণে না, শ্রদ্ধায়। আমকে কতজন চুপ করে ডেকে নেয়, গায়ে মথায় হাত বুলায়। আদর করে। ফিসফিস করে বলেন, '' তোমার আব্বার মতো হতে পারবো না আমরা। কিন্তু এরকম একজন মানুষকে দেখেছি এই আমাদের সার্থকতা।'' আমি চুপচাপ শুনি। আনন্দে আমার চোখে পানি আসে কি না সেটা বিষয় না। বরং আব্বাকে বলি, ধুরো বাকি টাকাটা লাগবে না। অনেক হইছে।

আব্বা বলেন, এটা শুধু আমার পাওনা না, এটা ওদের পরাজয়। নোটঃ আমার আব্বা মোঃ আব্দুর রব এখনো ভাবেন দেশে আইনের শাসন আছে। তবে সেটার সার্ভিস অনেক ধৈর্য্য ধরে ত্যাগ তিতিক্ষা করে পেতে হয়।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


সর্বশেষ সংবাদ