প্রাথমিক শিক্ষায় পড়ার চাপ কমাতে ‘লার্নিং বাই ডুয়িং’

দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা যখন লক্ষ্যহীন অভিযাত্রায় একই ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত, তখন ১৩ মার্চ ১৯ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ কর্মসূচীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছোট্ট সোনামণিদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে মাত্রাতিরিক্ত বই ও পড়াশোনার চাপ কমানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। যার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মমতাময়ী জননীর মাতৃদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। সরকারপ্রধান হিসেবে তার এ উপলব্ধি ও অভিব্যক্তিতে সমগ্র জাতির মনের কথা প্রকাশ পেয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর এই গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা বাস্তবায়নে নতুন কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা পাইলট প্রকল্পের নামে সংশ্লিষ্টদের কালবিলম্ব করার সুযোগ দেয়া বাঞ্ছনীয় হবে না। দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে ও প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার যথার্থতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলে, জাতি আবার পিছিয়ে পড়বে। কেননা, প্রাথমিক শিক্ষাই জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি।

প্রসঙ্গত, ১৯৫২, ৬৬, ৬৯ ও ৭১ সালে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে সমগ্র জাতি একক জাতিসত্তায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু ’৭৫ পরবর্তী সময়ে যথাযথ নেতৃত্ব ও স্কুল-কলেজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত কারিকুলামের অনুপস্থিতি ও শিক্ষাদান অব্যাহত না থাকায় অতীতে জাতি বার বার বিভ্রান্তির পথে ধাবিত হয়েছে। দিকভ্রান্ত জাতি অব্যাহতভাবে একই ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হয়েছে এবং এর ফলে একক জাতিসত্তার সুদৃঢ় ঐক্য দানা বাঁধতে পারেনি।

এমনি পরিস্থিতিতে বাঙালী জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একক জাতিসত্তায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে (কিন্ডার গার্ডেন, মাদ্রাসা ইত্যাদিসহ) আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত অডিও-ভিডিও শিক্ষাক্রম সংযোজন এবং তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

শিক্ষা সাংবিধানিক অন্যতম মৌলিক অধিকার হলেও দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন সুবিন্যাসিত না হওয়ায় নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে চলছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার এ নানামুখী চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ে প্রাথমিক স্তরের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বই ও পড়াশোনার চাপে তারা ন্যুব্জ প্রায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে নতুনত্ব ও শিক্ষাদান পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।

আমাদের এ অঞ্চলে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের শুরু থেকেই একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, ‘শিক্ষা’ মানে পড়া মুখস্থ করা আর পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করা এবং লেখাপড়া শেষে একটি চাকরি খোঁজা। কিন্তু ‘শিক্ষা (Education)’ শব্দটির অর্থ এতই ক্ষুদ্র! সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে কি ‘শিক্ষা’ শব্দটিকে আটকিয়ে রাখা যথার্থ?

শিক্ষা বা Education শব্দটির ব্যাপকতা বিশাল। শিক্ষার একটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- Education is the process of faciliting learning or the acquisition of knowledge, skill, values, beliefs and habits.

বর্তমান বিশ্বে ১. ফর্মাল, ২, ইনফর্মাল, ৩. নন ফর্মাল এ তিন ধরনের শিক্ষাই শিক্ষা হিসাবে স্বীকৃত। শুধু বিদ্যালয়ে যাতায়াত করলে ও পড়লেই শিক্ষা হয় না। শিক্ষা শব্দের অর্থবোধক প্রয়োগ দরকার। যে কোন মানুষ, যে কোন পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সে শিক্ষা ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সৃজনশীল বুদ্ধি সৃষ্টি করে এবং শিক্ষাকে আনন্দময় হিসাবে গ্রহণ করে- তখনই তাকে ভাল শিক্ষা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। বই ও লেখাপড়া যদি শিশুদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তখন তাকে শিক্ষা বলা যাবে না।

দেশের সমগ্র প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শিক্ষার মূল দর্শন হওয়া উচিত ‘লার্নিং বাই ডুয়িং’ (Learing by Doing)। এ দর্শনের ভিত্তিতে ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজাতে হবে। এতে বই ও পড়াশোনার চাপ যেমন হ্রাস পাবে, তেমনি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে পড়াশোনা ভীতি দূর হয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত আনন্দময় হবে।

খেলার ছলে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা গেলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও কর্মে মনোযোগী হবে। ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সকল কাজ ও শিক্ষাকে উপভোগ্য হিসাবে গ্রহণ করবে এবং কাজ ও কাজের মানুষের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা এবং সম্মানবোধ জন্ম নেবে। যা পর্যায়ক্রমে কাজ ও কাজের মানুষকে ঘৃণা বা অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি থেকে ছেলে-মেয়েদের বাইরে আনা সম্ভব হবে এবং জীবনের বিভিন্ন বাঁকে কাজকে সম্মান করে কাজে আগ্রহী হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। বৃদ্ধি পাবে জাতীয় উৎপাদনশীলতা।

ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা ঘুম থেকে উঠা ও ঘুমানো পর্যন্ত প্রতিদিন যেসব সমস্যা অতিক্রম করে সেসব সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিতে সৃজনশীল (Problem-solving& creative thinking) চিন্তায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এবং জীবনব্যাপী স্ব-স্ব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী ও প্রযুক্তি ব্যবহার শিখবে এবং পর্যায়ক্রমে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করবে। ফলে সমগ্র জাতির মধ্যে এক সময়ে ‘দক্ষতা সংস্কৃতি’ (Skill Cultural) গড়ে উঠবে। যার মধ্য দিয়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা দক্ষ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত হবে। এর ফলে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের (IR 4.0) চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং টেকসই উন্নয়নের (Sustainbale Development) জন্য আমাদের সম্ভাবনার বিশাল জনরাশিকে জনসম্পদে পরিণত করার ভিত্তি রচিত হবে।

আমাদের জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে সর্বক্ষেত্রে (প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা) শিক্ষা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা প্রবর্তন ব্যতীত কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা ও দক্ষতা একটি অপরটির পরিপূরক। একটি ব্যতীত অন্যটি পঙ্গু বিধায় কোন ফলাফল বয়ে আনবে না। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে ‘লার্নিং বাই ডুয়িং’ পদ্ধতি প্রবর্তনে এই মুহূর্তেই বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিম্নক্ত কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে-

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমের মূলভিত্তি বিবেচনাপূর্বক মূল স্রোতধারার শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ লার্নিং বাই ডুয়িং পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নে যথাযথ নির্দেশনা প্রদান।

১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসের উপযোগী কি ধরনের ব্যবহারিক (Practical) শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য যথাযথ ইক্যুইপমেন্ট এবং প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতি ও সহজ ব্যবহার বিষয়ে মডিউল তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা। এর ফলে একদিকে যেমন ছেলে-মেয়েরা ভবিষ্যতে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠবে, অন্যদিকে উন্নত দেশের ন্যায় সরকার ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ ভাগ কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তন করা সম্ভব হবে।

‘লার্নিং বাই ডুয়িং’ শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন করে কারিগরি শিক্ষক তথা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।

পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে শিল্পী, ফিজিক্যাল, নৃত্য, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত বিষয়ক শিক্ষকসহ সামগ্রিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে কি কি ধরনের শিক্ষক প্রয়োজন তার ভিত্তিতে শিক্ষক কাঠামো তৈরি করা।

দেশের সকল প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা ও শহীদ দিবস উদযাপন, জাতির পিতার সংগ্রামী জীবনের ওপর অডিও ভিডিও ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রবর্তনসহ দৈনিক ক্লাস শুরুর প্রাক্কালে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং ২-৩ বাক্যের একটি শপথনামা পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম বেগবান হওয়ায় বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে অত্যন্ত শক্তিশালী। শুধু শিক্ষার জন্য শিক্ষা নয়। জীবন জীবিকা, উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য যদি শিক্ষা হয়, সেই শিক্ষা প্রাথমিক স্তর থেকে ব্যাপক জনরাশিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। পরিণত হবে মানবসম্পদে। বিষয়টি উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক স্তরের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠদানে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নার্থে বর্ণিত সুপারিশসমূহ সরকার ও সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

লেখক : সভাপতি, আইডিইবি

 


সর্বশেষ সংবাদ