চৌকিদার তাহলে চোর না?

  © টিডিসি ফটো

সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দিল্লির মসনদে আবারো নরেন্দ্র মোদী এবং তার দল বিজেপি। যদিও সকল বুথ ফেরত সমীক্ষায় আগেই অনুমেয় ছিল নরেন্দ্র মোদীর এই জয়। তবে, এভাবে বিরাট ব্যবধানে তিনি যে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন বিশ্লেষক এবং বিরোধী পক্ষগুলো মানতে নারাজ ছিলেন।

অনেক ক্ষেত্রে, বিরোধী নেতারা বুথ ফেরত সমীক্ষাকে প্রথমদিকে ভিত্তিহীন বলেছিলেন। রাহুল গান্ধী থেকে মমতা সকল বিরোধী শিবিরের নেতারা এই সমীক্ষাকে ভুয়া বলেছিলেন। আসলে, এই নেতারা মোদীর জয়কে অনুমান করলেও দলের নেতা-কর্মীদের শান্ত রাখার জন্য তা করেছিলেন।

নরেন্দ্র মোদীর এই বিজয় রাহুল ও মমতার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিজয় সুনিশ্চিত করল। ভারতীয়রা দেখেছেন, মোদীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তাদের নিরাপত্তা যেমন সুনিশ্চিত তেমনিভাবে হিন্দুত্ববাদও বিকাশমান। গেরুয়াবাহিনীর এই জয়ে ভারতে বসবাসকারী মুসলিমরা ভীত। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী এবং রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের জয়ে উত্তর প্রদেশের নয়াবান গ্রামের মুসলমানদের পালানোর খবর এসেছে রয়র্টাসের প্রতিবেদনে।

ভোটের আগে টাইমসের প্রতিবেদনে নরেন্দ্র মোদিকে ‘বিভাজক শাসক’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। যদিও বিজেপি এই সংবাদ বিশ্লেষককে পাকিস্তানী স্বার্থবাদী বলেছিলেন। তবে, যাইহোক নির্বাচনের পূর্বে নরেন্দ্র মোদির বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন- ধ্যানে বসা, পাকিস্তানে বির্তকিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানো এবং গরু নিয়ে সহিংসতার ঘটনা এগুলো রয়র্টাসের প্রতিবেদনকে যথাযথ স্বীকৃতি দিচ্ছে।

২০১৯ সালের এই ১৭তম নির্বাচনকে ভারতীয়দের মতামতের প্রতিফলন হিসেবে যেমন বিরোধীপক্ষগুলো মেনে নিয়েছে তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। মোদিকে রাহুল, মমতা থেকে শুরু করে জাপান, রাশিয়া, ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্রের শাসকরা অভিনন্দন জানিয়েছে। আমাদের তাই প্রত্যাশা থাকবে নরেন্দ্র মোদি এবার দায়িত্ব গ্রহণ করে বিরোধী পক্ষ দ্বারা তার উপর আরোপিত অভিযোগগুলোকে তিনি তার নেতৃত্বশৈলীর মাধ্যমে ভুল প্রমাণ যেমন করবেন। তেমনিভাবে তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতির ভারত গড়ে তুলবেন।

গত বিজেপি ও মোদি সরকারের বড় ব্যর্থতা হিসাবে বিরোধীদলগুলো দেখিয়েছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারা। দ্য ন্যাশনাল স্যাস্পল সার্ভের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ আর্থবছরে ভারতের বেকারত্ব বেড়েছে ৬.১ শতাংশ। গত ৪৫ বছরে এত বেকার তৈরি হয়নি। রাহুল গান্ধী তার নির্বাচনী প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদিকে যা বলে সবচেয়ে বেশি কটাক্ষ করেছিল তা হল, ‘চৌকিদার চোর’ অর্থাৎ মোদী শাসনামলের দুর্নীতিকে তিনি সামনে আনতেন।

অভিযোগ ছিলো, ঋণ খেলাপি হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদি এবং আম্বানিদের ব্যবসায়িক সুবিধা দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদির সরকার। আরও বড় অভিযোগ ছিল ধর্মীয় উগ্রবাদকে উসকে দেওয়া। তবে, এবারের নির্বাচনের ফরাফলে যেখানে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৩৪৯ টিতে জয়লাভ করেছে তা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, জনগণ বিরোধীদের এই অভিযোগগুলোতে কর্পাত করেননি, মন ভুলেনি তাদের।

বরং, তারা মোদির মত দাপুটে নেতাকেই চাইছেন ভারত শাসনের জন্য। সাধারণ জনগণ ভারতের স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির জন্য মোদি নেতৃত্বাধীন জোটকে শ্রেয়তর মনে করেছেন। তথাপি, মোদির উচিৎ হবে এই শাসনকালে তার সরকারের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগগুলো সুন্দরভাবে সমাধান করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।  আসামের এন.আর.সি সংকট, বাবরী মসজিদ সমস্যার মত ধর্মীয় সংকটগুলোর শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সমাধান করা। যেহেতু, ভারতীয় জনগণ তার প্রতি আস্থা রেখেছেন তাই তিনি বিষয়গুলোর প্রতি দায়িত্বশীল হবেন আশা করা যায়।

এখন আসা যাক, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসের মত বিরোধীলগুলোর ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধানের দিকে। এবারের নির্বাচনে বিজেপির অন্যতম স্লোগান ছিল ‘আব কি বার, মোদি সরকার’ অর্থাৎ আবার নিয়ে আসুন মোদি সরকার। অন্যদিকে, কংগ্রেসের অঘোষিত স্লোগান ছিল ‘চৌকিদার চোর।’ 

স্লোগান দুটি পর্যবেক্ষন করলে দেখা যায় যে, লোকরঞ্জনবাদী নেতা নরেন্দ্র মোদি তার বিগত সরকারের উন্নয়ণের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য জনসমর্থন চাইছেন। অন্যদিকে, কংগ্রেস চেয়েছিল, গেরুয়াবাহিনীর দুর্নীতিকে দেখিয়ে জনসমর্থন আদায় করতে। কিন্তু, জনগণ যে এই স্লোগানকে ইতিবাচকভাবে নেয়নি তার ফলাফল এই নির্বাচনে মোদি বাহিনীর জয়।

দ্বিতীয়ত, ভারতীয় জনগণ যেভাবে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে ক্যারিশম্যাটিক বা সম্মোহনী নেতা হিসাবে নিয়েছিলেন সেভাবে নেননি রাহুলকে। কংগ্রেসের উচিত ছিল ভারতীয়দের আবেগকে পুজিঁ করার জন্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসা।

তৃতীয়ত, আরএসএস সমর্থিত বিজেপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে ভারতে যেভাবে হিন্দুত্ববাদের বীজ বপন করেছিল তা নিয়ে গঠণমূলক সমালোচনা এবং কাজ না করতে পারার কারণে বাম ধর্ম নিরপেক্ষদলগুলোসহ বিরোধী পক্ষগুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।

চর্তুথত, কাশ্মীরের পুলাওয়ামা হামলার প্রতিবাদে যে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ মোদি সরকার পাকিস্তানে চালিয়েছিল, তা ভারতীয় জনগণ ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। নির্বাচনের পূর্বে এই ধরনের কান্ড বরং মোদির ভোট বাড়িয়েছে।

পঞ্চমত, বিরোধীপক্ষগুলো সাংগঠনিকভাবে বিজেপির চেয়ে দুর্বল ছিল। নতুবা, এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও লোকরঞ্জনবাদী মোদির ক্ষমতার কেন্দ্রে আর্বিভাব ঘটত না। নতুন এই বিজেপি সরকারের প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর প্রত্যাশা থাকবে শক্তির রাজনীতি, ধর্মের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এবার যেন মোদি নেতৃত্বাধীন সরকার ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিকে মনোনিবেশ করেন।

আশা থাকবে, মোদির সরকার ক্ষীণ এশিয়ার সংগঠণ সার্ককে শক্তিশালী করে রোহিঙ্গা সংকট থেকে শুরু করে বিবামান বিভিন্ন বিষয়গুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধানে উদ্যোগী হবেন। এখন দেখার বিষয় মোদীর সরকার তার বিশাল জনসমর্থনকে ইতিবাচক না নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করেন। ভারতীয় জনগণের ‘জাতীয়তাবাদী’ চেতনার এই বহিঃপ্রকাশ কতটুকু স্থায়িত্ব পায় তা এখন সময়েই বলে দিবে।

লেখকঃ- মোঃ হাসান তারেক
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা


সর্বশেষ সংবাদ