দিদি নয়, স্যার শব্দটা নিয়ে আমার লেখা

শুনলাম এক ম্যাজিষ্ট্রেট আপাকে দিদি বলায় লাথি খেয়েছেন কয়েকজন মৎস্যজীবী। এই ঘটনার সত্য মিথ্যার বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। যেহেতু তিনি ক্ষমা চেয়েছেন তাকে বরং আমার শ্রদ্ধা। আমি তাকে কোনোভাবেই দোষও দেব না। তিনি প্রশাসনে শত বছর ধরে চলে আসা স্যার কালচারকে ধারণ করে কাজটা হয়তো করেছেন। কাজেই তাকে নয়, স্যার শব্দটা নিয়ে আমার লেখা। আমি নিজে এমন বহু ঘটনা জানি। কতো শুনবেন?

কাজের সুবাদে প্রশ্ন করতে গেলে, এক জুনিয়র ম্যাজিষ্ট্রেট আমার এক সাংবাদিক সহকর্মীকে বলেছিলেন, ভাই না, স্যার বলেন। এক জেলার জুনিয়র ম্যাজিষ্ট্রেট আমাকে বলেছিলেন, ডিসি অফিসে কোনো ভাই নয়। সবাইকে স্যার বলবেন। এমনকি অফিস সহকারীকেও। একটু পর অবশ্য ওই জেলার ডিসি সাহেবের সঙ্গে তিনি যখন আমাকে গল্প করতে দেখলেন এবং তাকে আমি ভাই সম্বোধন করছিলাম তখন তাকে বিব্রত হতে দেখি।

যদিও ওই ম্যাজিষ্ট্রেটের কাণ্ড ডিসিকে আমি বলিনি। বলে কী লাভ? কারণ সমস্যাটা মানসিক। আমি জানি না এই দেশের সব স্যারেরা জানেন না, কী না, এই রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু পরিচিত ছিলেন মুজিব ভাই নামে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও মুজিব ভাই। ১৯৭৫ সালে শ্রমিক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি চাকুরি করেন আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন।’

সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মনে রাখবা এটা ব্রিটিশ কলোনি নয়, এটা পাকিস্তান কলোনি নয়, যে লোককে দেখবা তার চেহারা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মত। ওরাই সবচেয়ে সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়।’ বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পরিচিত আপা নামে। অথচ এই রাষ্ট্রের বহু সরকারি বেসরকারি আমলা কামলা নিজেদের স্যার ভাবেন। স্যার না ডাকলে তারা মন খারাপ করেন। আরেকজনকে অপদস্থ করেন। জনগণকে তারা লাথি মারেন।

জানি না এদের মননে মগজে কী থাকে। শোনেন, হে স্যার ম্যাডামরা! মানুষ ভালোবেসে আপনাকে আপা ভাই কিংবা স্যারও বলতে পারে। আমি যেমন বহু মানুষকে স্যার বলি। কিন্তু স্যার না শুনলে যদি আপনার আত্মা জ্বলে যায়, তাহলে আর কে কী ভাবে জানি না। আমি বুঝে নেই, আপনাকে দিয়ে এই দেশের বা মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু হবে না। বরং আপনার চিকিৎসা দরকার।

মনে রাখবেন, যাকে দিয়ে দেশ মানুষের উপকার হবে, যিনি মানুষের ভালোবাসায় বিশ্বাস করেন তিনি সত্যিকারের স্যার, তাকে স্যার না ভাই বললেন, তাতে তার কিছু যায় আসে না। জানি না স্যারদের বোধোদয় হবে কী না নাকি প্রশাসনে থাকা আমার বন্ধুরা মন খারাপ করবেন! জানি না তাদের প্রশিক্ষণে বিষয়গুলো কেন শেখানো হয় না! জানি না স্যার না শ‌ুনলে যাদের মন খরাপ হয়, তাদের কেন মনোচিকিৎসক দেখানো হয় না। জানি না তারা জানে কী না, সাধারণ নাগরিকদেরই তাদের স্যার বলার কথা। আমি জানি না প্রশাসনে থাকা আমার দারুণ সব মেধাবী বন্ধুরা কেন বিষয়টার সংস্কারের কথা ভাবেন না।

আবার অবাক কাণ্ড, আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা যারা সত্যিকারের শিক্ষক তাদের স্যার বললেও প্রশাসনে থাকা স্যারেরা আবার তাকে স্যার বলতে লজ্জা পান। আমি বহু আমলাকে বাবার বয়সী প্রিন্সিপালকে প্রিন্সিপাল সাহেব আর স্কুলের প্রধান শিক্ষককে হেডমাষ্টার সাহেব বলতে শুনেছি।

তারা এই শিক্ষা কোথা থেকে পান? আচ্ছা এই স্যারেরা কী জানে, ব্রিটেন বা ইউরোপে স্যার বলে কিছু নেই অথচ ব্রিটিশ ভূতটিকে আছে ভারতবর্ষে। কেউ চাইলে স্যার শব্দটার উৎস খুঁজতে পারেন। নাইট উপাধি পাওয়া লোকটিকে শুধু স্যার বলা হয়। আমার সৌভাগ্য আমি যেখানে এখন কাজ করেছি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেই বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকে সেই স্যার আছেন।

কিন্তু তাকে সবাই আবেদ ভাই বলেন। সেখানে নিয়ম করা আছে সবাই সবাইকে ভাই বা আপা বলতে হবে। এর আগে প্রথম আলো পত্রিকায় একযুগ কাজ করেছি। সেখানেও ভাই। তারপরেও পথেঘাটে বা ফোনে কেউ কখনো আমাকে স্যার বললে আমি খুব বিব্রত হই এবং তাকে থামিয়ে দেই।

জানি না আমাদের স্যারদের বোধ হবে কী না, তবু বলি, মনে রাখবেন, আমাদের কৃষক, আমাদের পুষ্টিহীন পোষাককর্মী আর কোটি প্রবাসীরা আছেন বলেই দেশটা টিকে আছে। আপনার মতো স্যারদের কারণে নয়। সরকারি স্যারেরা মনে রাখবেন, সাধারণ মানুষ খুব বেশি কিছু চায় না। কাজ না করতে পারলেও একটু সম্মান করুণ।

তারা বলবে, স্যারটা ফেরেশতার মতো। এভাবেই বহু সরকারি কর্মকর্তাকে এদেশের স্থানীয় মানুষজন অন্তর থেকে ভালোবেসেছেন। তারা সত্যিকারের স্যার। দেশটা টিকে আছে তাদের মতো সত্যিকারের স্যারদের কারণে। কাজেই আপনারা যারা স্যার শুনতে চান, তারা সম্পদ না বোঝা সেটি অবসরে গেলে টের পাবেন!

গত ৫০ বছরে কম করে হলেও ৫০০ সচিব অবসরে গেছেন। কয়জনকে মানুষ মনে রেখেছে? আশা করছি বোধগুলো জাগ্রত করবেন। শুভ রাত্রি সব স্যারেরা। তবে ভালো থাকুক সত্যিকারের স্যারেরা।

লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক


সর্বশেষ সংবাদ