মায়ের আঁচলের নিচে খুঁজে পাই সমস্ত সুখ

মায়ের সাথে লেখক
মায়ের সাথে লেখক  © সংগৃহীত

একটি কাল্পনিক কাহিনী দিয়ে শুরু করি। একবার কয়েকজন দেবদূত বড় একটা সমস্যা নিয়ে গেলেন ঈশ্বরের সাথে দেখা করতে। কিন্তু ঈশ্বর তাদের দেখা দিতে অনেক দেরি করছেন। দেবদূতগণের আর অপেক্ষা সইছেনা। হঠাৎ ঈশ্বর এসে তাদের বলে গেলেন- ‘তোমরা একটু বস, আমি আরেকটু কাজ করে আসছি।’ দেবদূতগণ আবারও অপেক্ষায় রইলেন। এবার আরও দেরি হচ্ছে। এবার তারা বিরক্তই হয়ে গেলেন। তারা আর অপেক্ষার ভার বইতে পারছেনা। ধৈর্যচ্যুতি ঘটল তাদের। চিৎকার করে বলতে লাগলেন-’ আপনি কী এমন কাজ করছেন যে আমাদের সাথে কথা বলার সময় হচ্ছেনা? আপনি তারাতারি আসুন, আমরা খুব বিপদের মধ্যে আছি।’

দেবদূতগণের এমন দাম্ভিকতা দেখে ঈশ্বর রেগে-মেগে ভয়ংকর চেহারা নিয়ে হুংকার দিতে দিতে এগিয়ে এলেন। বিকট আওয়াজে স্বর্গ-নরকের সর্বস্থানে ভূমিকম্প শুরু হল। স্বর্গবাসী দেবতারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উপস্থিত হলেন ঈশ্বরের দরবারে। দেবদূতগণও তাদের এমন বেয়াদবির জন্য নিরুপায় হয়ে হাঁটু গেরে বসে থাকলেন। তারা প্রস্তুত যে কোন শাস্তির জন্য। আজ বুঝি তাদের আর রক্ষে নেই। ঈশ্বর আসলেন সবার সামনে। তবে হঠাৎ তিনি যেন কী চিন্তা করলেন। কোন কথা না বলে আবার চলে গেলেন ঘরের ভেতরে। সবাইতো অবাক! কী করছেন উনি? আজ ঈশ্বরকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন? সকলের মন এমন অদ্ভূত ঘটনার পরশে কেমন জানি আন্দোলিত হচ্ছে। কৌতুহলী মন একবার পর্বতে উঠছে তো আরেকবার পাতালে নামছে। কী হতে যাচ্ছে আজ? কী ঘটবে আজ?

অবশেষে অনেকক্ষণ পর ঈশ্বর বেরিয়ে এলেন। যিনি জগৎস্রষ্ট্রা! ভাগ্য বিধাতা! থর থর করে কাঁপতে থাকা দেবদূতগণকে ইশারায় সরে যেতে বল্লেন। হাঁফ ছেড়ে বাচল তারা। উপস্থিত দেবতারা ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘হে জগৎস্রষ্টা! হে জগৎশ্রেষ্ঠ ! আপনি এতক্ষণ কী করছিলেন আমরা কী জানতে পারি?

জবাবে ঈশ্বর বল্লেন- ‘ আমি আজ বেশ কয়েকদিন ধরে একটি অস্তিত্ব গড়তে চাচ্ছি। একটি আত্মা গড়তে যাচ্ছি। সেই অস্তিত্ব বা আত্মার নাম দিয়েছি ’মা’। তবে আমি এখনও তাঁকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারিনি। কারণ, একজন ’মা’ গড়া খুবই কষ্টের কাজ।
সমবেত দেবতারা অবাক হয়ে বল্লেন- ‘হে ঈশ্বর! আপনার নিকট এমন কোন কাজ আছে যা অসাধ্য?

ঈশ্বর আবার জবাব দিলেন,- ‘অবশ্যই আছে। একজন মায়ের যে কত দায়-দায়িত্ব, তা মেলানো খুব কঠিন। তাঁর সব দিক সামলাতে হয়। সব কিছু সহ্য করতে হয়। তাঁর মধ্যে যে কোমলতা আছে, তা বিশ্বের সব কোমলতার চেয়েও বেশি। তাঁর মধ্যে যে মায়া মহব্বত আছে তা মাহাবিশ্বের গভীরতার চেয়েও বেশি গভীর। তোমাদের জন্য যে স্বর্গ আমি তৈরি করেছি, তার চেয়ে বড় স্বর্গ আমি তৈরী করেছি মায়ের পায়ের নিচে। স্বর্গের চেয়ে হাজার হাজার গুণ সুখ আর শান্তি আমি দিয়েছি একজন মায়ের আঁচলের নিচে। এখন আবার চিন্তায় পড়ে গেলাম একজন মায়ের হাত কয়টি দেব?

সমবেত দেবতারা আবার প্রশ্ন করলেন,- ’কেন? হাত দুটি দিলে কোন ক্ষতি আছে?’
ঈশ্বর বল্লেনন- ‘আছে। কারণ একজন মায়ের শুধু একদিক সামলাতে হয়না। সংসারের আরও দশটি দিকও তাঁর হাতেই সামলাতে হয় যা পুরুষেরা দেখেও দেখেনা। বুঝেও বুঝেনা। তাই আমি অনেক গবেষণার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, মায়ের হাত হবে দুটি, সেগুলোর ক্ষমতা হবে দশটি হাতের মত যেন অন্য দশটি কাজও তিনি সামলাতে পারেন।’
এই বলে ঈশ্বর আবার তার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং ’মা’ গড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জানিনা তিনি কতদিনে ’মা’ গড়তে পেরেছিলেন। ঘটনাটা কাল্পনিক হলেও মর্মার্থ অনেক। আশা করি সবাই অনুধাবন করতে পেরেছেন।

প্রতিদিনই মাকে অনেক অনুভব করি। মায়ের কথা মনে পড়লে যে বিষয়টি আমার প্রথমেই চোখে ভাসে, তা হলো তাঁর সরলতা। এ সরলতার আঁধার যেন মহাকাশের চেয়েও বেশি জায়গা সম্বৃদ্ধ। মা যখন আমায় ডাকেন, তখন একসাথে পাঁচটি নাম বলেন। কখনও একবারে বলতে পারেন না। সবার নাম বলে তারপর আমার নাম বলেন। এভাবে বলেন- এই সুমন---ইমন---নোমান—টিটু—ধুরু যা ছোটন(আমার নাম)। অর্থাৎ উনার চোখে সবসময় উনার সকল সন্তান দৃশ্যমান। তাই একজনকে ডাকতে গিয়ে সবার নাম বলে ফেলেন। মনে হয় যেন মায়ের আত্মা আমাদের সবার সাথে রাত-দিন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের নিরাপদে রাখছে। কয়েকটি কথা ,যা কিছুদিন আগেও লিখেছিলাম তার মধ্য থেকে কয়েকটি লাইন আবারও বলি-

আমার মা এখনও নিজের হাতে আমাদের জমির ধান ঘরে তুলেন। মাকে ছোট থেকে দেখে আসছি। তাঁর সাথে সাথে থেকেছি। যতটুকু পারি সাহায্য করেছি। আমরা পাঁচ ভাই মিলে একসময় মাকে সাহায্য করতাম। ধান গাছ থেকে ধান ছাড়ানো হয়ে গেলে বাড়ির ওঠানে ধান ছড়িয়ে রাখা হতো। সেগুলোর উপড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আগাছগুলোকে কুলো দিয়ে বাতাস দিয়ে দিয়ে সরাতেন আমার মা। এভাবে সকাল থেকে সন্ধা। এখনও করে যাচ্ছেন। মৃদু মন্দ বাতাসের বিপরীতে, কুলোর উপর ধান রেখে মা যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধান ঝারতেন, তখন মনে হতো আমেরিকার সেই বিখ্যাত মূর্তি, “স্ট্যাচু অব লিবার্টি”। সারা রাত ধরে মা সেগুলোকে বড় একটা পাতিলে সিদ্ধ করতেন।পরদিন সকালে সেগুলোকে রৌদ্রে শুকানোর জন্য দেওয়া হয়। রোদের ছোঁয়ায় সোনালী ধান ঝিলিক মারে। এই ঝিলিক দেখে আমার মায়ের সারা বছরের পরিশ্রম তাঁর এক গালের হাঁসি দিয়েই বেরিয়ে যেত। এই হাঁসি প্রশান্তির হাঁসি। ক্লন্তি দূর হওয়া হাঁসি। মায়ের সেই হাঁসি দেখে মনে হতো হেমন্তে ফোটা গন্ধরাজ,মল্লিকা,শিউলী আর কামিনী ফুল।’’

আজ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার। তাই নাকি আজ বিশ্ব ’মা দিবস’। মাকে ছেড়ে বহুদিন ধরে দূরে এক জায়গায় চাকুরী করছি। মায়ের কথা বলতে গিয়ে আজ আবার সেই ছোট্ট বেলায় ফিরে গেলাম। মাকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা বলে নিই ছোটদের মতন -

সবার আগে চোখেটি মেলে তোমায় প্রথম দেখি
দেখে দেখে সাধ মেটেনা, তবুও যেন বাঁকি,
মাগো তুমি একটি বাগান, আমরা সেথায় ফুল
বুকের মধ্যে আঁগলে নিতে হয়না তোমার ভুল,
একটু একটু হাঁটতে শিখি, ফিরে ফিরে তোমায় দেখি
যেইনা আমি পড়ে যেতাম, তুমি দিতে তুলে,
বলতে হেঁসে –আমার বাবা আমার বাবা!
হবে যখন অনেক বড়, তখন তুমি কী হবা?
মগো তোমার মুখের হাঁসি, খাঁটি হীরার চেয়েও দামি,
তোমার গালে টোল পড়িত, কতবার যে ছুঁতাম আমি!


সর্বশেষ সংবাদ