মান্যতা ও ভালোবাসাই মাকে শ্রদ্ধার শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য

  © প্রতীকী ছবি

মা হচ্ছেন গর্ভধারিণী একজন পূর্ণাঙ্গ নারী। মা স্বার্থহীন ভাবে ১০ মাস ১০ দিন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তানের জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে বড় করে তোলেন। স্নেহ-মমতা-ভালবাসা দিয়ে নিজের জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সন্তানকে লালন পালন করে তিনিই অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। প্রকৃতিগতভাবে একজন নারী বা মহিলাই সন্তানকে জন্ম দেয়ার অধিকারিনী। গর্ভধারণের ন্যায় জটিল এবং মায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অবস্থানে থেকে এ সংজ্ঞাটি বিশ্বজনীন গৃহীত হয়েছে। তার বিপরীত লিঙ্গ পুরুষ হচ্ছেন বাবা। মাতৃত্ব হল ত্যাগ, তিতিক্ষা, আবেগ, অনুভূতি, স্নেহ-ভালবাসা ইত্যাদি ইত্যাদি, ভাষা নেয় প্রকাশ করার। মায়ের এই ত্যাগ, অনুভূতি ও আবেগ এক কথায়, এক বাক্যের বা একি আর্টিকেল বা একটি বই লিখে বুঝানো যাবে না। তাই মাতৃত্বের সাথে পৃথিবীর কোনো কিছুর তুলনা করা যায় না। মা’র তুলনা শুধু মা।

ইসলামসহ সকল ধর্মেই মাতা-পিতাকে সর্বোচ্চ সম্মান ও অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে মাতা-পিতার সম্মান, অধিকার ও অবস্থান নিয়ে এখানে কিছু আলোকপাত করতে চাই। ইসলাম ধর্মের বিধান মতে আল্লাহ তাআলার পরেই মাতা-পিতার স্থান। এ প্রসঙ্গে পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন ও হাদীস সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে।

আল কোরআনে বলা হয়েছে, `আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করা এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, এটা মানুষের প্রতি তাদের প্রতিপালকের আদেশ। মাতা-পিতার একজন অথবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তাহলে তাদের প্রতি অবজ্ঞামূলক, অসৌজন্যমূলক ও বিরক্তিকর আচারণ করবে না এবং তাদেরকে ধমক দেবে না। তাদের সঙ্গে সর্বদাই সম্মানসূচক কথা বলবে। মায়া-মমতার বশে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা প্রসারিত করো এবং তোমার প্রতিপালকের (আল্লাহ) কাছে বলো, হে আল্লাহ তুমি আমার মাতা-পিতার প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন’ (সুরা-১৭ ইসরা-বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩-২৪)।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের অন্যত্র আরও বলেছেন, ‘আমিতো মানুষকে তাদের মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেন এবং আল্লাহতাআলার নিয়ামত তার দুধ পান করে সন্তান জীবনধারণ করে। সুতরাং আমার (আল্লাহর) প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে’ (সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত: ১৪)। ‘আমি (আল্লাহ) মানবজাতিকে আরও নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করে। কারন তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছেন ও অতিকষ্টে প্রস্রব করেছেন এবং লালন-পালন করেছেন’ (সুরা-৪৬ আহকাফ, আয়াত: ১৫)। পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তার সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৩৬)।

মহান আল্লাহ তাআলা নবজাতক হযরত ঈসা (আ.)-এর মুখে ভাষা ফুটিয়ে দিলেন; তখন তিনি বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা, আমাকে কিতাব (আসমানি গ্রন্থ ইঞ্জিল) দেওয়া হয়েছে এবং তিনি (আল্লাহ) আমাকে নবী করেছেন। আর আমাকে বরকতময় করা হয়েছে আমি যেখানেই থাকব; আর আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সালাত ও জাকাত বিষয়ে, যত দিন আমি জীবিত থাকব’। হযরত ঈসা (আ.) আরও বলেন, ‘আমাকে আর ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমি যেন আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করি (অনুগত ও বাধ্য থাকি); আমাকে করা হয়নি উদ্ধত অবাধ্য ও দুর্ভাগা হতভাগ্য’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৩০-৩২)। আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের নবী হযরত মুসা (আ.)-এর প্রতিও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি বনি ইসরাইল থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছি যে তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৮৩)।

মাতা-পিতা সন্তানের সম্পদের অধিকারী ও উত্তরাধিকারী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মাতা-পিতা উভয়ের প্রত্যেকের জন্য (সন্তানের) সম্পদের এক–ষষ্ঠাংশ যদি তার সন্তান থাকে; আর যদি সন্তান না থাকে, তবে পিতা-মাতাই ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী হবেন, এমতাবস্থায় তার মায়ের জন্য এক-তৃতীয়াংশ’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১১)। পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত আয়াতগুলোতের মাধ্যমে আমাদের প্রতিপালক স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আল্লাহর পরেই মাতা-পিতার অধিকার ও সম্মান। সেই অধিকার ও সম্মান কীভাবে আদায় করতে হবে, সেটাও বলা হয়েছে।

হাদীসেও মাতা-পিতার অধিকার ও সম্মান নিয়ে বহু জায়গায় বলা হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল কে আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার বেশি হকদার? হযরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন ‘তোমার মা’, সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’, সে আবারও বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। সে পুনরায় বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা’ (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘মাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত’। মাতা-পিতার খেদমত না করার কারণে যারা (মুসলমান) জান্নাত থেকে বঞ্চিত হলো, রাসুল (সা.) তাদের অভিসম্পাত দিয়েছেন। হাদীস শরিফে এসেছে—‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) একদা জুমার দিনে মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন; অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন; তার পর তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন। তারপর খুতবাহ দিলেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আজ যা দেখলাম তা এর আগে কখনো দেখিনি। আপনি একেক ধাপে পা রেখে আমিন, আমিন, আমিন বললেন, এটা কি কোনো নতুন নিয়ম নাকি’? প্রিয় নবী (সা.) বললেন- ‘না, এটা নতুন কোনো নিয়ম নয়; বরং আমি মিম্বারে ওঠার সময় হযরত জিবরাইল (আ.) এলেন; আমি যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখি, তখন হযরত জিবরাইল (আ.) বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা মাতা-পিতা উভয়কে বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক’। তখন আমি (রাসুল (সা.) সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘আমিন (তা-ই হোক)। আমি যখন মিম্বারের দ্বিতীয় ধাপে পা রাখি, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা রমজান পেল কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন। আমি যখন মিম্বারের তৃতীয় ধাপে পা রাখি, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা আপনার পবিত্র নাম মোবারক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনল, কিন্তু দরুদ (নবীজির প্রতি শুভকামনা) শরিফ পাঠ করল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন’।

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় একজন বিখ্যাত আশেকে রাসুলের ঘটনা আমরা জানি। যিনি প্রিয় রাসুল (সা.)-কে দেখেননি। উনার নাম হযরত ওয়াইস আল করনি (রা.)। মায়ের সেবা করার কারণে নবীজি (সা.)-এর জমানায় থেকেও তিনি সাহাবি হতে পারেননি। তবে এতে করে তার মর্যাদা কমেনি, বরং তিনি সম্মানিত হয়েছেন। একবার ওয়াইস করনি (রা.) প্রিয় রাসুল (রা.) কাছে খবর পাঠালেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আপনার সঙ্গে আমার দেখা করতে মন চায়, কিন্তু আমার মা অসুস্থ। এখন আমি কী করতে পারি? রাসল (সা.) উত্তর পাঠালেন, আমার কাছে আসতে হবে না। আমার সাক্ষাতের চেয়ে তোমার মায়ের খেদমত করা বেশি জরুরি ও বেশি ফজিলতের কাজ। শুধু তা-ই নয়, রাসুল (সা.) তার গায়ের একটি জুব্বা তার জন্য রেখে যান এবং বলেন, মায়ের খেদমতের কারণে সে আমার কাছে আসতে পারেনি; আমার ইন্তেকালের পর আমার এ জুব্বাটি তাকে উপহার দেবে। বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জুব্বাটি রেখে যান হযরত ওমর (রা.)-এর কাছে এবং তিনি বলেন, হে ওমর- ওয়াইস আল করনির কাছ থেকে তুমি দোয়া নিয়। সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন আমাদের ওয়াইস করনির মতো মায়ের সেবা ও খেদমত করার মাধ্যমে আল্লাহ ও তার রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করুন-আমিন।

তাই মাকে শুধু বছরে একদিন আধুনিক ‘মা দিবসের’ বাণিজ্যিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে না রেখে, সকল সন্তানের উচিত মাকে প্রতিদিনের আবেগ, অনুভূতি, স্নেহ-ভালবাসার মধ্যে স্মরণ করা এবং তাকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া।

লেখক: সিনিয়র সাইন্টিস্ট,  নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র


সর্বশেষ সংবাদ