এশিয়ার সেরা হতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যা করা জরুরি

  © ফাইল ছবি

এশিয়ার ৪১৭টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করেছে লন্ডন-ভিত্তিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’। তালিকায় নাম নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং-এ বাংলাদেশের কেবল মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। দুটিরই অবস্থান ৮০০ থেকে ১০০০ এর মধ্যে।

এই র‌্যাংকিং-এ ও ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে স্থান পাওয়া এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। অনেকেই মনে করেন, গবেষণায় পিছিয়ে থাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনার সাইটেশনের অভাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। কৃষি ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণায় কিছু সাফল্য থাকলেও অন্যান্য বিষয়ে গবেষণায় একদম পিছিয়ে বাংলাদেশ। যদিও আমাদের দেশে সমস্যা নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু করণীয় নিয়ে কথা হয় অনেক কম। কী করা দরকার তাহলে?

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বাস্তবায়নযোগ্য ৯টি পরামর্শ লিখেছি এই লেখায়। নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, যদি বাস্তবায়ন হয় এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ১০ এর মধ্যে আসতে পারে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়।

১. প্রথমেই বিজ্ঞানের প্রত্যেকটা শাখায় একটি করে জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল দরকার। অনেকটা ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’ এর আদলে। এই কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট শাখায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে পার্টনারশীপ এর ভিত্তিতে সেমিনার এবং রিসার্চ মেথডোলজির উপর ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিংয়ের আয়োজন করবে। শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, পেশাজীবী, পিএইচডি ও এমফিল গবেষকদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে প্রকল্প গ্রহণ করবে।

ধরুন, কাউন্সিল ১৫ দিনের একটা ওয়ার্কশপ আয়োজন করার জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে প্রপোজাল আহবান করবে, তারপর কাউন্সিল যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রপোজাল একসেপ্ট করবে। সম্প্রতি ইউজিসি এরকম কিছু প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা গবেষণা খাত উন্নয়ণে অবদান রাখবে বলে আশা করি।

এছাড়াও সংশ্লিষ্ট কাউন্সিল মাস্টার্স, এমফিল, ও পিএইচডি গবেষণার জন্য ফেলোশিপ প্রদান করবে। যেহেতু কাউন্সিল নিয়মিতভাবে সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিং এর আয়োজন করবে, সেহেতু কাউন্সিলের অধীনে কমপক্ষে ১০০ জন থাকতে পারে এরকম একটা আবাসিক সুবিধাও থাকা দরকার।

‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশ্যাল সাইন্স রিসার্চ’ এর নাম শুনেছেন অনেকে। এমন কোন সপ্তাহ নেই যে এই কাউন্সিলের অর্থায়নে ইন্ডিয়ার কোথাও না কোথাও সেমিনার, ওয়ার্কশপ বা ট্রেনিং হয়না। ৩০ জন পিএইচডি গবেষকের জন্য পুনেতে আয়োজিত এমন একটা ওয়ার্কশপে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল।

২. বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স এর থিসিসের উপর প্রতিবছর তিনজনকে স্বর্ণপদক প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেক বিভাগ থেকে তিনজনের থিসিস বাছাই প্রক্রিয়ার জন্য জমা নেবে। তারপর বিশ্বৰিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরো বিশ্বৰিদ্যালয় থেকে তিনজনকে থিসিসের জন্য স্বর্ণপদক প্রদান করবে। এতে মাস্টার্স পর্যায়ে থিসিসের ব্যাপারে আরো মনোযোগী হবে ছাত্র-ছাত্রীরা।

৩. কথা হলো, ভালো গবেষণা করতে তো টাকা দরকার। আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের থিসিসের জন্য টাকা পাবে কোথা থেকে? কাউন্সিল কিছু কিছু থিসিস অর্থায়ন করবে। এছাড়াও আমাদের ব্যাংকগুলো তাদের সিএসআর খাত থেকে যেভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তি দেয়, সেভাবে আবেদনের প্রেক্ষিতে থিসিসের জন্য স্কলারশিপ দিতে পারে। তবে শর্ত থাকবে যে উক্ত গবেষণা সে পাবলিশ করবে।

আর শিক্ষকদের গবেষণার জন্য ফেলোশিপ প্রদান করবে সংশ্লিস্ট কাউন্সিল। বাণিজ্যিক বিষয়গুলোতে গবেষণার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন করা দরকার। ব্যাংকগুলো তাদের সিএসআর খাত থেকে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তি দিতে পারলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন গবেষণার জন্য অর্থায়ন করবেনা?

শেখ ফরিদ

৪. প্ল্যাজারিজম চেক করার সবচেয়ে জনপ্রিয় সফ্টওয়ার হলো ‘টার্নিটিন’। এটা ব্যায়বহুল বিধায় শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য কেনা কষ্টসাধ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা বিভাগে এই সফটওয়্যার থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রত্যেক পিএইচডি গবেষণা, এমফিল গবেষণা, থিসিস, গ্রুপ রিসার্চ-এর প্রতিবেদনের সাথে ‘টার্নিটিন’ থেকে প্ল্যাজারিজম চেক করার রিপোর্ট সংযুক্ত করতে হবে।

৫. এবার আসি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল নিয়ে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালগুলোর অধিকাংশই অনলাইনে পাওয়া যায়না। অধিকাংশ জার্নালের ই-আইএসএসএন নেই। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, বর্তমানে কেউ লাইব্রেরিতে গিয়ে জার্নাল আর্টিকেল পড়েনা। সবাই গবেষণা প্রবন্ধ খোঁজে ‘গুগল স্কলার’, ‘জেস্টর’, ‘সাইন্স ডাইরেক্ট’ এ।

এই সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে এভেইলেবল না হলে জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর কোন মূল্য নেই। দ্বিতীয়ত অনেকে জার্নালই প্ল্যাজারিজম চেক করেনা। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটা প্রবন্ধ প্রকাশের পূর্বে প্ল্যাজারিজম চেক বাধ্যতামূলক করা দরকার। কেউ মিশেল ফুকোর লেখা কপি করলে সেটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেইল দিয়ে জানাতে হবে কেন? সেটাতো প্রকাশ হওয়ারই কথা না।

৬. বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সব জার্নালগুলোর ইনডেক্সিং করতে পারে। ইউজিসি কেবল গুনগত মানসম্পন্ন জার্নালগুলোকে ইন্ডেক্সেড করবে। কিছুদিন আগে ‘বাংলাজল’ নামক একটা ওয়েবসাইট জার্নালগুলোর ইনডেক্সিং করা শুরু করে। তারা জার্নাল পছন্দ করার ক্ষেত্রে তেমন কোন উন্নত মানদণ্ড অনুসরণ করেনা।

ইনডেক্সিং এর বিশ্বাসযোগ্যতা ও গুনগত মান বাড়াতে এই দায়িত্ব ইউজিসিকে নিতে হবে। ভারতের ইউজিসি অবশ্য অনুমোদিত জার্নালের তালিকা প্রকাশ করে, প্রয়োজনে সেটাও বিবেচনা করা যেতে পারে।

৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রত্যেক ধাপে ‘ওয়ব অব সাইন্স’/‘স্কোপাস’-এ ইনডেক্স করা আছে এমন জার্নালে কমপক্ষে একটি করে প্রকাশিত আর্টিকেল থাকা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে পারে। এর জন্য আগে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কাউন্সিল থেকে তাদের জন্য গবেষণার উপর ট্রেইনিং এর ব্যবস্থা করা, এবং তাদের প্রস্তাবিত গবেষণার উপর পর্যাপ্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। গবেষণার জন্য অর্থ পেলে ভালো গবেষণা হবে, ভালো জার্নালে প্রকাশও সম্ভব হবে।

৮. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন (২০১০) অনুযায়ী সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর বাজেটে গবেষণা খাতে একটি অংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। অথচ, সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কোন অর্থ ব্যয় করেনি। কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আয়ের ১৫ শতাংশ (কম বেশি হতে পারে) গবেষণা খাতে ব্যয় না করলে তাদের অনুমোদন বাতিলের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

৯. সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কেবল তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া দরকার, যারা গবেষণা করতে আগ্রহী, একাডেমিশিয়ান হতে চান বা হওয়ার যোগ্যতা আছে। সব চেষ্টা বৃথা হয়ে যাবে যদি এটা নিশ্চিত করা না যায়।

লেখক: গবেষক ও ফ্রিল্যান্স রাইটার
ই-মেইল: fariddu100@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ