একটি ন্যায্য দাবির যেভাবে অপমৃত্যু হলো!

বাংলাদেশের যুবনীতিতে যুবকদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর। সুতরাং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিটা অবশ্যই যৌক্তিক। দেশের মানুষের গড় আয়ু যখন ৪৫ বছর ছিল, তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর, আয়ু বেড়ে ৫০ হলে ৩০ বছর করা হয়। এখন আয়ু বেড়ে যাওয়ার পরও চাকরিতে প্রবেশের বয়স কোনোভাবেই ৩০ বছর থাকতে পারে না।

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। সে হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অন্তত ৩৫ হওয়া উচিৎ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য বর্তমানে চাকরি শুরুর বয়স ৩০ হলেও মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটায় এই বয়স ৩২, নার্সের চাকরির জন্যে ৩৬ আর বিভাগীয় প্রার্থীর কোটায় ৩৫ বছর রয়েছে।

সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে ৫৭ থকে ৫৯ বছর, যা ৬১-তে উন্নীত করার আলোচনা চলছে। অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৬৫ বছর এবং বিচারকদের ৬৭ বছর।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বর্তমান বয়সসীমা বিশ্বের ১৬২টি দেশের সর্বনিম্ন বয়সের চেয়েও পাঁচ বছর কম। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো উন্নত দেশে চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছর। হাতেগোনা বিশ্বের কয়েকটি দেশে চাকরির সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ বছর হলেও বাংলাদেশে তার চেয়েও কমিয়ে ৩০ বছরে রাখা হয়েছে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন দেশের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আবার কিছু দেশে চাকরিতে প্রবেশের নির্দিষ্ট বয়স নেই। চাকরি হতে অবসরের আগের দিন পর্যন্ত চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ রাখা হয়েছে। এছাড়া চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৫৫ বছর রাখা হয়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে।

এ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, অস্ট্রেলিয়া, মালায়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি দেশ। একমাত্র দেশ সুইডেন চাকরির বয়স ৪৭ বছর রেখেছে। চাকরির বয়স ৪৫ বছর রেখেছে যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা।

আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৪০, বিভিন্ন প্রদেশে বয়সসীমা ৩৮ থেকে ৪০। আফ্রিকায় চাকরি প্রার্থীদের বয়স বাংলাদেশের সরকারি চাকরির মতো সীমাবদ্ধ নেই। অর্থাৎ চাকরিপ্রার্থীদের বয়স ২১ হলে এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলে যেকোনো বয়সে আবেদন করা যায়।

রাশিয়া, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্যে যোগ্যতা থাকলে অবসরের আগের দিনও যে কেউ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন। চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ বছর রেখেছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। এরমধ্যে কাতার, তাইওয়ান, এঙ্গোলা, ইতালী ও নরওয়ে উল্লেখযোগ্য।

যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল গভর্নমেন্ট ও স্টেট গভর্নমেন্ট উভয় ক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়স কমপক্ষে ২০ বছর এবং সর্বোচ্চ ৫৯ বছর। কানাডার ফেডারেল পাবলিক সার্ভিসের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০ বছর হতে হবে, তবে ৬৫ বছরের উর্ধ্বে নয় এবং সিভিল সার্ভিসে সর্বনিম্ন ২০ বছর এবং সর্বোচ্চ ৬০ বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে আবেদন করা যায়।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ স্পিকার থাকাবস্থায় ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ২০১৮ সালের জুনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২৯তম সভায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার সুপারিশ করা হয়। এর আগে কমিটির ২১তম সভায় বয়স ৩২ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছিল।

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স পাঁচ বছর বাড়িয়ে ৩৫ করার বিষয়ে ফের সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি। একইসঙ্গে অবসরের বয়স বাড়ানোর বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। জাতীয় সংসদ ভবনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এ সুপারিশ করা হয়।

২০১৮ সালে ১৭ ডিসেম্বর  হোটেল সোনারগাঁওয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের ইশতেহার ঘোষণা করা হয় এবং সেখানে বলা হয় যে - সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে মেধা ও দক্ষতা বিবেচনায় রেখে বাস্তবতার নিরিখে যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ইশতেহারে প্রায় পাঁচ কোটি ৩০ লাখ তরুণদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, সরকার ক্ষমতায় গেলে তরুণরা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজন এবং তরুণদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির জন্য আবেদন করার আহ্বান জানাতে পারবে।

সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল মহান সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার প্রস্তাব করা হলে এক মিনিটের ‘হ্যাঁ’, ‘না’ ভোটে প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়। এরমধ্য দিয়ে এদেশের তরুণ যুবাদের দীর্ঘদিনের একটি যৌক্তিক দাবিকে সুকৌশলে অপমৃত্যু ঘটানো হলো।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ