ভাষা আন্দোলনের রূপকার তমদ্দুন মজলিস

গ্রাফিক্স ছবি
গ্রাফিক্স ছবি  © সংগৃহীত

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলনের সূতিকাগার তমদ্দুন মজলিস। আন্দোলনের জনক বা রূপকার সংগঠন বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রাদেশিকতা, ধর্মীয় গোড়ামিল কিংবা ঐক্যের অজুহাত দিয়ে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই বাংলা ভাষাকে হত্যা করতে চেয়েছিল সরকার। বাংলাকে শাসকদের সেই কোপানল থেকে রক্ষা করতে যুক্তি প্রদর্শন এবং অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংগ্রামের সূত্রপাত করে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসই। আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন পর্যন্ত আলোকজ্জ্বল ও ইতিবাচক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন মজলিসের সংগঠকরা। রাজপথের সংগ্রামেও ছিল নেতা-কর্মীদের দীপ্ত পদচারণা।

১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তমদ্দুন মজলিস যে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়েছিল, ১৯৫২ সালে তা-ই বিস্ফোরিত হয়েছে দাবানল হয়ে। আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসলেও এ সংগঠনটির যাত্রা তমদ্দুন মজলিসের একটি রাজনৈতিক শাখা হিসেবেই। সাংগঠনিক ভূমিকার কারণেই তমদ্দুন মজলিসকে ভাষা আন্দোলনের অভিভাবক বলা চলে। আর এ সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল কাসেম ছিলেন আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। 

নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বাপর সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ নিয়ে নানা ধরণের মত-আলোচনা তৈরি হয়। পাকিস্তানের যাত্রার শুরু থেকেই সরকারীভাবে সকল কাজকর্ম, মুদ্রিত ফরম, ডাকটিকেট, স্ট্যাম্প, মানি অর্ডার ফরম, মুদ্রা, সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে শুধু উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। বাংলা শুধু সরকারি কাজ থেকেই বাদ দেয়া হয়নি, বরং নানাক্ষেত্রে এর ভাষাভাষীদের উপেক্ষাও করা হয়। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্ব থেকেই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি জোরালো ছিল। রাজধানীসহ সকল প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, তা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির সাথে একীভূত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস।

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির ১৮ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। শুরুতে এর সদস্য ছিলেন তখনকার এস এম হলের ভিপি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), এসএম হলের সমাজসেবা সম্পাদক শামসুল আলম, ফজলুর রহমান ভূঁইয়া, একেএম আহসান, কবি মোফাখখারুল ইসলাম, আব্দুল খালেক (পরে পুলিশের আইজিপি)। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়াও এর গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন। ১৯ নম্বর আজিমপুরে আবুল কাসেমের বাসার একটি কক্ষে এর কার্যালয় স্থাপিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম অফিস, সূতিকাগার এটিই। পরে এর অফিস রশিদ বিল্ডিংয়ে স্থানান্তর করা হয়। ওই দিনই এক বৈঠকে ১৬ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ভাষা-আন্দোলন ও মজলিসের আদর্শ-উদ্দেশ্যের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে সাংগঠনিক পক্ষ পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ তাঁর ‘জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫-৭৫ বইয়ে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপকদ্বয় আবুল কাসেম ও নুরুল হক ভূঁইয়া ধূমায়িত অসন্তোষকে সাংগঠনিক রুপদানের প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস গঠন করেন। নবগঠিত তমদ্দুন মজলিসই ভাষা-আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ‘ভাষা-আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস’ বলেন, ‘... তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এরপর ঢাকায় এই প্রথম ভাষা-আন্দোলন একটি সাংগঠনিক ভিত্তি অর্জন করে। ইতোপূর্বে ভাষা প্রসঙ্গটি পত্র-পত্রিকায় আলোচনা ও বিবৃতি দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তমদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে ভাষা প্রশ্নটি পত্র-পত্রিকার বাইরে সাধারণ আলোচনা ও অংশগ্রহণের সুযোগ এনে দেয়।’ 

১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা- না উর্দু?’- শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস। ঘোষনাপত্রটি প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলন এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পায়। এটি আন্দোলনের নীতি নির্ধারণও করে দিয়েছিল। ওই দিন বিকালেই তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান- ঢাকা কলেজ) ছাত্রাবাস নূপুর ভিলায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দু করা হোক শীর্ষক এক ঘরোয়া সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করাই ছিল সেমিনারের মূল লক্ষ্য। এতে ঘোষনাপত্রের উপর বিস্তারিত আলোচনাশেষে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে অংশগ্রহণকারীরা একমত হন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, কবি জসীম উদ্দীন, অধ্যাপক কাজী আকরাম হোসেন, অধ্যাপক শামসুল হক, শাহেদ আলী, সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী। (সূত্র: আমি যখন সাংবাদিক ছিলাম; সানাউল্লাহ নূরী।)

সেপ্টেম্বরের বাকি দিনগুলিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জনমত গঠন এবং মজলিসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো, ঢাকার বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচারণা চালান। রাজধানীর বাইরে মজলিসের শাখা গঠন শুরু হয়। অক্টোবরে গণসংযোগের পাশাপাশি আইন-পরিষদ ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করেন মজলিসের নেতারা। প্রচারণায় ঘোষনাপত্র পুস্তিকা ছাড়াও লিফলেট বিতরণ করা হয়। কর্মীদের হাতে লেখা পোস্টার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সাটিয়ে দেয়া হয়। এ সময় মজলিস কর্মীরা বিভিন্নস্থানে বাধারও শিকার হন। প্রচারণায় সাড়া দেননি অনেক শিক্ষিত বাঙালিও। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, ‘পুস্তকটি (ঘোষনাপত্র) কিনিবার মত ৫ জন লোকও প্রথমে পাওয়া যায় নাই। আমি মজলিসের কয়েকজনকে নিয়া বইটি লইয়া বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করিয়াছি। ব্যক্তিগতভাবে বহু লোকের সঙগে আলাপ করিয়াছি, কিন্তু ২/১টি ছাড়া তাঁর প্রায় জায়গাতেই নিরাশ হইয়াছি। ...শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র মুসলিম হল ও ফজলুল হক হলেও আমরা - বৈঠক করার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইয়াছি। শুধু তাই নয় আমরা রুমে রুমে গিয়া ব্যক্তিগত আলোচনাও চালাইয়াছি- কিন্তু ২/১জন ছাড়া প্রায় ছাত্রই ইহার প্রতি বিরুপভাব দেখাইয়াছিলেন।’ (ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস; প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম)। 

সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সভা আয়োজনের মাধ্যমে মজলিস রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার প্রাথমিক প্রয়াস চালায়। ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সংবর্ধনা উপলক্ষে আয়োজিত সভায় ভাষার প্রশ্নে বিদগ্ধজন বাংলার পক্ষে মত দেয়। একই ধরণের আরেকটি সভা কিছু দিন পর ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। মজলিসের উদ্যোগে সাহিত্যিক ও ছাত্রদের এক আলোচনা সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আনুষ্ঠানিক দাবি জানানো হয়। সভায় উপস্থিত কয়েকজন মন্ত্রীও দাবির স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন। এ মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহার, বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী নূরুল আমীন, কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ মো. আফজাল। শিক্ষিতজনের মধ্যে সমর্থন আদায়ের চেষ্টার সাথে সাথে চলে রাজনীতিকদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও। ১৪ তারিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে শতাধিক বিজ্ঞজনের স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়। রাজনৈতিক নেতাদের সাথে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তর্ক ও দেনদরবার চলে। এ প্রসঙ্গে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম বলেন, ‘অতপর আমরা কয়েকজন সাহিত্যিক ও কয়েকজন সরকারী কর্মচারীর সহিত আলাপ আলোচনা চালাইয়া কিছুটা সাফল্য অর্জন করি। এই সময়ে দেশের নামকরা ব্যক্তিদের দস্তখত লইয়া একটি মেমোরেন্ডাম তৈয়ার করা হয়- আর আমরা অলিতে গলিতে ঘুরিয়া বহু কষ্টে এই দস্তখত সঙগ্রহ করি। মেমোরেন্ডামটি গভর্নমেন্টের কাছে পেশ করা হয়। ...যাহারা দস্তখত করিয়াছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন সরকারী কর্মচারী। এমনকি পুলিশ বিভাগের আইজি, ডিআইজিও ইহাতে দস্তখত করিয়া সমর্থন জানাইয়াছিলেন। এই সময়ে কয়েকজন মন্ত্রীও গোপনে ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করিতে থাকেন।’

তমদ্দুন মজলিস প্রচারপত্র

 

২৭ নভেম্বর করাচিতে শুরু হওয়া পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ফজুলর রহমান উর্দুকে দেশের লিংগুয়া ফ্রাংকা (সাধারণ ভাষা) করার প্রস্তাব করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠে। এরপর শুধু আলোচনায় দাবি আদায় হবে না, বুঝতে মাঠের আন্দোলনে নামে তমদ্দুন মজলিস। ফজলুর রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে ৪ ডিসেম্বর মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির কাছে হাজার হাজার লোকের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করে তমদ্দুন মজলিস। ৫ ডিসেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও ছাত্র মিছিল নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসভবনে (বর্ধমান হাউজ) যান। সেখানে তখন মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলছিল। ওই বৈঠকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান তাঁরা। সন্ধ্যায় আলোচনাশেষে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁ ঘোষণা করেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষা চাপানোর চেষ্টা হলে পূর্ব-পাকিস্তান বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং আমি সে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেব। (পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি; প্রথম খন্ড; বদরুদ্দীন উমর; ঢাকা)। 

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রসভার আয়োজন করে তমদ্দুন মজলিস। অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সভাশেষে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি সেক্রেটারিয়েটের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে। এদিনই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ‘পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষা সমস্যা’ শীর্ষক সভায় আকরম খাঁ উর্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। এরইমধ্যে ১২ ডিসেম্বর এক দল লোক বাস ও ট্রাকে চড়ে উর্দুর পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বুয়েট) ছাত্রাবাসে হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে মিছিল করেন বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীরা। তারা শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করেন এবং পলাশী ব্যারাকের কাছে পথসভা করেন। দাবীর মুখে শিক্ষামন্ত্রী মিছিলে অংশ নেন এবং দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে হামলার প্রতিবাদে ও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি অফিসে ধর্মঘট পালিত হয়। স্বাধীন পাকিস্তানে সরকারি অফিসে এটিই প্রথম ধর্মঘট। ওই দিন থেকে ১৫ দিনের জন্য ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। এমনকি ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ দিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ, অমৃত বাজার, যুগান্তর, আনন্দবাজারসহ ভাষা আন্দোলনের পক্ষের পত্রিকাগুলোকে পূর্ব-বাংলায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। 

৩০ ডিসেম্বর রশিদ বিল্ডিংয়ে তমদ্দুন মজলিসের সভায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে পৃথক একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। তার প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়াকে সভাপতি করে ‘তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি’ গঠিত হয়। পরবর্তীতে এটিই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে পরিচিত হয়।


আন্দোলন বেগবান হতে শুরু করলে এবং সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সংবাদ প্রচারিত হলে আক্রমণের শিকার হয় তমদ্দুন মজলিস এবং এর কয়েকজন সংগঠক। ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি রশিদ বিল্ডিংয়ে মজলিস অফিসে হামলা ও ভাংচুর করে পুরান ঢাকার উর্দুভাষীদের একাংশ। একাধিকবার হামলার শিকার হন অধ্যাপক আবুল কাসেম। বলিয়াদী প্রেসে হ্যান্ডবিল ছাপাতে গিয়ে কসাইটুলীতে বন্দি হন মজলিস কর্মী সিদ্দিক উল্লাহ। তার গলা কেটে ফেলার পূর্ব মুহুর্তে এক ব্যক্তির হস্তক্ষেপে তিনি মুক্ত হয়ে পালিয়ে যান। এক পর্যায়ে পুলিশ রশিদ বিল্ডিংয়ের অফিসটি তালাবন্ধ করে দেন। এ অবস্থায় ২৫ জানুয়ারি তমদ্দুন মজলিস অফিস ১৯ আজিমপুরে আবুল কাসেমের বাসায় স্থানান্তর করা হয়। 

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে উর্দু ও ইরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। কিন্তু তার প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়। প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার প্রতিবাদে ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৬ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘পূর্ব-পাকিস্তান প্রতিবাদ দিবস’ পালনের জন্য পূব-পাকিস্তানের ছাত্রদেরকে আহবান করতে সংগ্রাম পরিষদকে অনুরোধ করা হয়। এ অনুরোধের প্রেক্ষিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদ ও পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১১ মার্চ পূব-পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি দুই সংগঠনের প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। এতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কয়েকজনকে আটক করলে ১১ মার্চ ধর্মঘটের পাশাপাশি হরতাল পালনেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১ মার্চ তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম, পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, মুসলিম ছাত্র লীগের আহবায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ এবং এসএম হলের ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরী ধর্মঘট-হরতাল সফল করার আহবান জানিয়ে যুক্ত বিবৃতি দেন। এ বিবৃতি ১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। (দৈনিক আজাদ; ২ মার্চ ১৯৪৮)। 

এ বছরের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে তমদ্দুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথসভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন ও সম্প্রসারিত করা হয়। পরিষদে এ দুই সংগঠনের বাইরেও অন্য দলীয় পরিচয়ের ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়। এটিই দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বা প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে পরিচিত। সম্প্রসারিত পরিষদের আহবায়ক হন শামসুল আলম এবং যুগ্ম-আহবায়ক হন আবদুল মান্নান। ওই সভায়ও ১১ মার্চ হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১১ তারিখ সকাল সাড়ে সাতটা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হতে শুরু করে ছাত্র-শ্রমিক-পিকেটাররা। ইঞ্জিয়ারিং কলেজসহ বিভিন্ন কলেজ থেকে খন্ড খন্ড মিছিল এসে জড়ো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের পাশাপাশি রেল কর্মচারী লীগ, কেন্দ্রীয় কর্মচারী সংঘ এদিন হরতাল পালনে বড় ধরণের ভূমিকা রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সংক্ষিপ্ত সভার পর স্লোগানরত ছাত্র-জনতা সচিবালয়ের দিকে যাত্রা করেন। ঘন্টার পর ঘন্টা সেক্রেটারিটে ভবন অবরুদ্ধ রেখে মন্ত্রীদের সাক্ষাত প্রার্থনা করেন আন্দোলনরতরা। তখন ঐ স্থানে অনেক পাঞ্জাবি পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছিল।

ওই সময়ের বর্ণনায় অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘জনতার স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হইয়া কিছু সংখ্যক সরকারী কর্মচারীও ইডেন বিল্ডিং হইতে বাহির হইয়া পড়েন। ছাত্রগণ ঘন্টার পর ঘন্টা সেক্রেটারিয়েট ভবন ঘিরিয়া রাখেন ও মন্ত্রীদের সাক্ষাত প্রার্থনা করে। অবস্থাকে ঘোরালো করার জন্য আন্দোলনবিরোধী কতিপয় লোক কয়েকজন মন্ত্রীকে অপমান করেন। অন্যদিকে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী জনাব আবদুল হামিদ সাহেবের নিকট হইতে বাঙলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার লিখিত প্রতিশ্রুতি ও আগাম পদত্যাগপত্র আদায় করা হয়। ইহার পর হঠাৎ গুন্ডাদলের আক্রমনের সংবাদ পাইয়া ছাত্রগণ ইডেন বিল্ডিং ত্যাগ করিয়া আসে।’ এসময়ই পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে। গ্রেফতার করা হয় কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ অনেককে। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন এ কে ফজলুল হক এবং অধ্যাপক আবুল কাসেমও। পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে জানান, ওই দিন ২০০জন আহত, ১৮ জন গুরুতর আহত এবং ৯০০জনকে আটক করা হয়। এর মধ্যে অনেককে ছেড়ে দেয়া হলেও ৬৯জনকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। (আনন্দবাজার পত্রিকা; ১৩ মার্চ ১৯৪৮)। 

আন্দোলনের তীব্রতায় সরকার দিশাহীন হয়ে পড়ে আলোচনার প্রস্তাব পাঠায় তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাসেমের কাছে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত সভায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নিয়ে চুক্তি করেন। আন্দোলনের বিজয় প্রাথমিকভাবে সূচিত হয়। এরপর পাকিস্তানের গভর্নর মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ এমন ঘোষনায় প্রতিবাদ করে মজলিস। তবে সরকারি নানা পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নকে জাগরুক রাখে তমদ্দুন মজলিস।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আবারও রাজপথের আন্দোলনের সূচনা হয়। সেই তুমুল আন্দোলনের পথ ধরে বাংলা পায় রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। তখনও আন্দোলনে নেতৃত্বের সারিতে ছিল তমদ্দুন মজলিস ও অধ্যাপক আবুল কাসেম। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় সংগ্রাম পরিষদ অপেক্ষাকৃত বেশী সক্রিয় ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা যখন ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিলের বিরোধিতা করেছিল, তখনও মিছিলের পক্ষে সম্মতি এবং প্রস্তুতি নেয় মজলিসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। মফস্বলে আন্দোলনকে সংগঠিত করে তমদ্দুন মজলিসই। এজন্য ২১-২২ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর মজলিস অফিস ও অধ্যাপক কাসেমের বাসায় পুলিশ তল্লাশি করে। আবুল কাসেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। প্রায় দুই মাস তাকে আত্মগোপনে থাকতে হয়।

তখনকার আন্দোলন প্রসঙ্গে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ বইয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলনেও তমদ্দুন মজলিসের দান অপূরনীয়। সংগ্রাম পরিষদে তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক ও কর্মীরা থাকিয়া নানাভাবে সাহায্য করে। বিভিন্ন হলে, কলেজে ও স্কুলে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে মিলিয়া ইহাকে জোরালো করিয়া তোলে। মজলিস কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত ‘সৈনিক’ ভাষা আন্দোলনে সাংবাদিকতায় নেতৃত্ব দিয়াছে বলা যায়। মফস্বলে অধিকাংশ স্থানে ১৯৫২ সনে মজলিসের নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলন হইয়াছে।’ 


সর্বশেষ সংবাদ