আধুনিকতার সংস্পর্শে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতি

বর্তমানে আধুনিকতার ভূত যেন ঘাড়ে চেপে বসেছে আমাদের। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি থেকেই দূরে সরে যাচ্ছি আমরা। পূর্বে নাকি বাংলা মায়ের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরতি মাছ ছিলো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি নজরুল, পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কতো যে কবিতায়, গল্পে বাংলা মায়ের সেই রুপখানা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার ইয়োত্তা নেই।

গ্রাম বাংলার সেই চিরচেনা সবুজ মাঠ, পাঁকা সোনালী ধানের কৃষকের সেই বর্ণিল মাঠ, সরিষা ফুলে সেজে ওঠা বাঙলার রূপ যেন আজ প্রায় অচেনা। যেই বাংলা ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানেরা তাদের প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয়নি সেই ভাষা ছেড়ে আজ আমরা ভিনদেশী ভাষা রপ্তে ব্যস্ত। যেখানে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে তোতলিয়ে যাই সেখানে আমরা গর্বের সহিত ভিনদেশী ভাষা গবেষণার উদ্দেশ্যে বহির্বিশ্বে গমণ করছি।

যুগে যুগে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করে এসেছেন। বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাংলার সঙ্গে। বাংলা সাহিত্যের জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা বাংলাকে নতুন রূপ দান করে। বাংলা ভাষায় বিদ্রোহ করেই কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন ব্রিটিশদের বিরোধী লেখক, বাংলার বিদ্রোহী কবি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ লেখকরা বাংলার গদ্য সাহিত্য চর্চার দ্বারাই আজ পৃথিবী খ্যাত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন শুধু বাংলার জন্যই। বঙ্কিকচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা চর্চার মাধ্যমে আজ বাংলা সাহিত্যের জনক। বাংলা সাহিত্যকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতেই সুকান্ত ভট্টাচার্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, পল্লী কবি জসীমউদদীন, জীবনানন্দ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকরা তাদের সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন। যাদের জন্য বাংলাকে বিশ্ব জেনেছে, পড়েছে।

বর্তমানে সেই বাংলা সাহিত্যগতভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বাংলার জমিনে জন্মায়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমানে বাংলা ভাষার বিকৃতি ও অপব্যবহার বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কলুষিত করছে। আধুনিকতার সংস্পর্শে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ।বাংলার ঐতিহ্য সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে আমরা পশ্চিমা বিশ্বের ঐতিহ্য কে ধারণ করছি, লালন করছি।

বাংলার মেঠোপথ ধরে আজ আর বাংলার বধূদের ঘোমটা টেনে কলসি কাঁখে জল নিয়ে যেতে দেখা যায়না ,হাটে বাজারে খুঁজলেও আজ বাংলার লুঙ্গি গামছা পরিহিত কোনো যুবক বৃদ্ধের দেখা মেলে না। আজ বাংলার নারী যেন তার ঐতিহ্য ভুলে স্কার্ট, প্লাজোতে নিজেকে সাজাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। পুরুষেরা কোট, টাই, জিন্স আর রকমারী শার্টে নিজেদের সাহেব সাজাতে বেশি আগ্রহী। আধুনিকতা আর বিলাস বহুল জীবনে বাংলার মসলিন শাড়ির অস্তিত্ব নেই আজ। আজ আমরা বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বলাকে গর্বের মনে করি। নিজ দেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে বিদেশি সংস্কৃতিকে সানন্দে বরণ করে নিচ্ছি।

হয়ত এজন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-

বহুদিন ধরে বহু পথ ঘুরে
বহু ব্যয় করে বহুদেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,
দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হৈতে শুধু দুপা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।