করোনাকাল

করোনায় টিউশনি বন্ধ, জমিতে ধান চাষে ব্যস্ত চবি ছাত্র শিপন

করোনাকালে টিউশনি বন্ধ হওয়াতে মানুষের জমিতে কাজ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বাংলা বিভাগ থেকে এম এ প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করা শিপন রায়। টাকার অভাবে এক সময় পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যাওয়া এই ছাত্র মানুষের বাড়ির টয়লেটও পরিষ্কার করেছেন। করেছেন নাপিতের কাজ। শিপন জানালেন, কিছু মূলধন সহায়তা পেয়েছি, তাই বেঁচে থাকার জন্য বা টিকে থাকার জন্য নতুন যুদ্ধ শুরু করি। এখন আমি বর্গাচাষ করি। এতে আমার কোনো লজ্জা নেই। আমি আমার জীবনের গল্পগুলো ফেসবুকেও লিখে রাখি।

শিপনের যুদ্ধটা শুরু হয়েছে সেই ছোট বেলা থেকেই। শিপন বলেন, আমার বয়স তখন নয় বা ১০ বছর। ঘরে কোনো খাবার নেই। রিকশা চালক ও আমাদের থেকে আলাদা থাকা বড় ভাই শ্বশুর বাড়ি গিয়েছেন। ভাইয়ের রিকশার তালা ভেঙে রিকশা নিয়ে বাজারে যাই। সারা দিনে ৮৫ টাকা রোজগার, মাকে চাল ডাল কিনে দিলাম। মা যে কি খুশি হয়েছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা নাপিতের কাজ করেছি। অনার্সে তৃতীয় বর্ষে গিয়ে নাপিতের কাজ বাদ দিলাম। পরে শুরু করি টিউশনি। করোনায় টিউশনি চলে গেছে। পরিবারকে কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়ে এখন আমি গ্রামে বর্গাচাষ করছি।

ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন পে ইট ফরওয়ার্ড, বাংলাদেশের বৃত্তি পাওয়া একজন শিক্ষার্থী শিপন। বিপদের সময় ওই সংগঠনের কাছ থেকেই আবার ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। তাই দিয়ে ফেনীর চরচান্দিয়া গ্রামে ৭০ শতক জায়গায় নিজেই আমনের বর্গাচাষ করছেন শিপন। জমির মালিক কোনো খরচ দিচ্ছেন না, তাই ৪৫ শতকের জমির ধান পাবেন শিপন।

শিপনের মা গীরু বালা রায়ও বলতে গেলে সারা জীবনই মানুষের জমিতে ও বাড়িতে কাজ করে ছেলে মেয়েদের বড় করেছেন। এখন অসুস্থ থাকায় আর কাজ করতে পারেন না। শিপনের এক ভাই নাপিতের কাজ করেন। আরেক ভাই রিকশা চালান। দুই ভাইই আলাদা সংসার পেতেছেন। দুই ভাই ও শিপন মিলে মায়ের খরচ দেন। নিজেদের বলতে গেলে কোনো জায়গাজমি নেই।

শিপনের বাবা স্বপ্ন রায় মানুষের জমিতে দিন মজুরি করতেন তিনি মারা গেছেন বহু বছর আগে। শিপনের এক বোনের বিয়ে হয়েছে। আরেক বোন তিন বছর ও ১৫ মাস বয়সী দুই সন্তান রেখে মারা গেলে শিপনকে দীর্ঘদিন এই দুই ভাগনে-ভাগনির খরচও দিতে হয়েছে। এখন ওরা তাদের বাবার কাছে থাকে। এখন ভাগনে পড়াশোনার পাশাপাশি কাঁকড়া ধরে তা বিক্রি করে তার বোনের পড়ার খরচ দিচ্ছে।

শিপন জানালেন, এই জীবনে একবার মাত্র এক মাস প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপরও এসএসসি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ফলাফল বেশ ভালোই হয়। কলেজে পড়ার সময় বিনা চিকিৎসায় বাবা মারা যান। বড় বোন মারা যান। এ সবের মধ্যে এইচএসসিতেও প্রথম শ্রেণি পান। ভর্তি কোচিং না করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স পান। ফলাফলের দিক থেকে অনার্সে প্রথম শ্রেণি এবং এম এ’তে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এম এ পরীক্ষার পর চট্টগ্রামে এক বস্তিতে থেকেছেন। এসময় এমফিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আর টিউশনি করতেন। করোনাভাইরাসের বিস্তারে এমফিলের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়নি। যে দুইটি টিউশনি করতেন তাও বন্ধ হয়ে গেছে।

ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন পে ইট ফরওয়ার্ড, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং চট্টগ্রামের কর কমিশনার বাদল সৈয়দ মুঠোফোনে বলেন, শিপন খুব সহজ সরল এবং ভালো ছেলে। ও যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তখন থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। শিপনের বাংলা বিভাগের তখনকার শিক্ষক ড. মহীবুল আজীজ শিপনের আর্থিক অবস্থার কথা বলে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। 

তিনি বলেন, শিপন এখন একটি চাকরি খুঁজছে। আমরাও চাই ও একটি ভালো চাকরি পাক। ওর আত্মসম্মানবোধ খুব প্রখর। করোনায় টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাকে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে সে গ্রামে গিয়ে বর্গা চাষ করছে।

এত কষ্টের মধ্যেও শিপন বলেন, বাবা যে ঋণ রেখে গিয়েছিলেন তা সব শোধ করে দিয়েছি। এখন একটা চাকরি হলেই মাকে নিয়ে একটু ভালো ভাবে থাকতে পারব। তিনি বলেন, ঢাকা বা অন্য কোনো জায়গা থেকে কেউ আমার খোঁজ করেছেন এ বিষয় জানতে পারলেই মা ভাবেন, এইবার মনে হয় আমার চাকরি হয়েছে, সেই খবর দেওয়ার জন্যই আমাকে খুঁজছেন কেউ। আমার এখন একটি চাকরি খুব জরুরি।