টিউশনিও এখন অনলাইনে!

পড়াশোনার পাশাপাশি আয়ের সহজলভ্য, সার্বজনীন উপায় হিসেবে বিবেচিত হয় টিউশন। করোনা মহামারি আকার ধারণ করলে শুরু হয় লকডাউন, আর বদলে যায় বাস্তবতা। অন্য সবার মতো সব ছেড়ে ঘরবন্দী জীবন শুরুও হয় টিউশন নির্ভর শিক্ষার্থীদেরও। সাথে পড়াশোনার পাশাপাশি আয়ের একমাত্র উৎসও বন্ধ হয়ে যায়।

আর্থিক সংকটাপন্ন সে পরিস্থিতি থেকে বের হতে ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে টিউশন চালিয়ে নিতে শুরু করেছেন কেউ কেউ। নেটওয়ার্ক দুর্বলতা, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতার অভাব, মিথস্ক্রিয়ার কমতিসহ নানা সমস্যার পরও অনলাইন টিউশন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে টিউশনের উপর নির্ভরশীল শিক্ষার্থীদের।

কীভাবে চলছে সে অনলাইনে টিউশনের কার্যক্রম, তা দেখতে হাজির হয়েছিলাম চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে। সেখানে আরাফাত উদ্দিন নামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী অনলাইনে পড়াচ্ছেন। পড়ানোর জন্য যুক্ত হতে ব্যবহার করা হয় গুগল ডু, হোয়াটসঅ্যাপ, জুম বা গুগল ক্লাসরুমের মতো সফটওয়্যারগুলো। তবে এক্ষেত্রে দেখা যায়, শারীরিক উপস্থিতি না থাকায় মিথস্ক্রীয়ার কমতি থাকলেও শেয়ার হচ্ছে আবেগ, অভিজ্ঞতা, সচেতনতার সমসাময়িক নানান গল্প। তবে এটাই যে এই সময়ের একমাত্র ব্যবস্থা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

পড়ানো ভিডিও কলে হলেও থেমে নেই শিক্ষার্থীরা কতটা পড়ছে না পড়ছে তা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া। চলছে কাজ দেয়া-নেয়া। শিক্ষার্থী কাজ করে তার ছবি তোলে পাঠিয়ে দিয়েছে শিক্ষকের ইনবক্সে। সীমিত পরিসরে পরীক্ষাও চলে অনলাইনে। সেক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় গুগল ক্লাসরুমের মতো অ্যাপগুলো।

করোনা মহামারির কারণে দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হলে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন শরীফ উল্লাহ এজাজ। ক’দিন আগে অভিভাবকের সাথে আলোচনা করে টিউশন অনলাইনে চালিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কিন্তু পৌরসভার মধ্যে তার অবস্থান হলেও যেতে হচ্ছে ভয়াবহ নেটওয়ার্ক দুর্বলতার মধ্য দিয়ে। দিতে হচ্ছে ধৈর্যের পরীক্ষা। ফলে একই কথা বলতে হয় বারবার। তারপরও মন্দের ভালো হিসেবে শুরুটা অন্তত করতে পারায় খুশি তিনি।

একজন গৃহশিক্ষকের সরাসরি উপস্থিতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে কার্যকর একটা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে। কিন্তু ডিজিটাল উপস্থিতির কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সে মিথস্ক্রিয়া অনেকটাই অনুপস্থিত।

আগামীদিনের শিক্ষায় এ দূরশিক্ষণ পদ্ধতি একটা ভালো বিকল্প হতে পারে জানিয়ে এজাজ বলেন, ‘অনলাইনে পড়ানোর ফলে নানা জটিলতার পরেও যাতায়াতসহ অন্যান্য সময় বাঁচিয়েছে ব্যাপকহারে। একটা টিউশনে যদি শিক্ষার্থীকে পড়ানো হয় দেড় থেকে দু’ঘন্টা, প্রস্তুতি আর যাতায়াতের বাড়তি সময়ে বিনিয়োগ করতে হতো আরো এক ঘন্টা সময়। অনলাইন শিক্ষা সে সময় সঞ্চয় করতে সহায়তা করছে। সাথে সাথে ঘরে থাকার পরিমাণ বাড়ায় কমেছে করোনার ঝুঁকি।’

শিক্ষকের সম্মানীর সাথে বাড়তি খরচ করে মেগাবাইট কিনে কেন অনলাইনে পড়ছেন? এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম কয়েকজন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের কাছে। ইশরা ইবতিশাম নগরীর বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীতে পড়ছেন। তার মতে ‘একে তো দীর্ঘদিন বাসায় বসে আছি। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে সে আশায় বেশ কয়েকমাস সময় আমরা এরমধ্যে নষ্ট করেছি। এভাবে আমাদের সিলেবাস কমপ্লিট (সম্পূর্ণ) হবে না। তাই অনলাইনে শুরু করেছি।’ তবে এভাবে পড়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ধীরগতি খুব ঝামেলা করছে বলে জানান তিনি।

নগরীর দারুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রাফি আশরাফ জানান, ‘এখন এমন একটা পরিস্থিতি কেউ কারো বাসায় আসতে পারছে না। এক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আমরা সে সুযোগটা নিয়েছি। কিন্তু উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট আর তার ধীরগতি ক্লাস করতে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’

রাফির বাবা আহমদুল হক যিনি চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তার কথায়, লকডাউনে দীর্ঘদিন বাসায় থেকে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পড়াশোনা কমিয়ে দিয়েছে। অনলাইনে পড়ানোর ব্যবস্থা করে তার সাথে অন্তত বইয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছেন তিনি।

তবে ইন্টারনেট আর প্রযুক্তি পণ্যের উচ্চমূল্য সহনীয় রাখতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘আমি শহরে থাকি, আর্থিক সচ্ছলতা আছে। এখানে নেটওয়ার্ক ভালো। আপনি দেখবেন দেশের শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ছেলে-মেয়ে এ সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে না। তার উপর ইন্টারনেটের যেভাবে মূল্য বাড়ানো হয়েছে তা কমাতে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’ এমনও পরিবার আছে যারা তিনবেলা খেতে পারছে না, তারা নেট কোথায় পাবে? প্রশ্ন রাখেন তিনি।

অনলাইনে টিউশন করা চবি শিক্ষার্থী আরফাত উদ্দিন বলছেন, ‘শিক্ষার্থীরা যদি দীর্ঘসময় এভাবে পড়াশোনা বিমুখ থাকে তারা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হঠাৎ করে যদি পরীক্ষার শিডিউল দিয়ে দেয় এটা তাদের জন্য একটা আগাম প্রস্তুতি হিসেবে থাকবে। অনলাইনে হলেও পড়ার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে স্কুল খুললেও তাদের উপস্থিত পরিস্থিতি মানিয়ে নেয়া সহজ হবে।’

ইতোমধ্যে অনলাইন ক্লাস করানোর জন্য অনলাইন টিউশন গ্রুপগুলোতে পোস্ট করেছেন অনেকেই। বাদ যায়নি কোরআন পড়তে শিখানো বিজ্ঞপ্তিও। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতা নতুন হলেও ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছিন সবাই।

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে পাবলিক স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে সাদমান আহমেদ সাজিদ। অপেক্ষকৃত নীচের ক্লাসে পড়লেও এ ব্যবস্থায় বেশ ভালোমতো মানিয়ে নিয়েছে সে। তার মা সেলিনা পারভীনের মতে, স্কুলে মাঝে মাঝে অনলাইন ক্লাস হলেও পড়াশোনা কমিয়ে দিয়েছিল তা ছেলে। তাই ডাটা খরচ করে এভাবে পড়লেও ফল পাচ্ছেন তিনি।

তবে হাইস্কুল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এভাবে চালানো গেলেও উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়াদের জন্য এভাবে পড়ানোতে একটু জটিলতা আছে। আরফাত উদ্দীনের কথায়, ‘উচ্চ মাধ্যমিকের যারা বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়েন তাদেরকে এভাবে বোঝানো কঠিন।’