আয়া সোফিয়া ও ফিরে দেখা ইতিহাস

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান

সূচনা কথা

ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত দেশ তুরস্ক। তুরস্কের সাবেক রাজধানী ইস্তানবুল (ইস্তাম্বুল)। ইস্তানবুলকে বলা হয় এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার অন্তকরণস্থল। বসফরাস প্রণালীর পশ্চিম তীরবর্তী ইস্তানবুল শহরের ফাতিহ এলাকায় অবস্থিত বিশ্বখ্যাত স্থাপনা ‘আয়া সোফিয়া’ যা ‘হাগিয়া সোফিয়া’ নামেও পরিচিত। এক সময় এটি ছিল অর্থোডস্ক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় উপাসনালয়। এরপর পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত এটি ছিল তুরস্কের মুসলমানদের অন্যতম প্রধান মসজিদ।

১৯৩৪ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক একে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। গত ১০ জুলাই (শুক্রবার) তুরস্কের প্রশাসনিক আদালত কাউন্সিল অব স্টেট এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরিত করার নির্দেশ দেয়। রায় ঘোষণার পরপরই প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আদেশে স্বাক্ষর করেন। এর ফলে গত ১০ জুলাই দীর্ঘ ৮৬ বছর পর আয়া সোফিয়ার সুউচ্চ মিনার থেকে আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়। এ সময় আয়া সোফিয়ার উন্মুক্ত চত্বর ও আশাপাশের এলাকায় সমবেত তুর্কিরা তাদের জাতীয় পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলে সেখানকার পরিবেশ।

আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তর নিয়ে তুরস্কের অভ্যন্তরে ও বৈশ্বিক পরিম-লে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ তুর্কি এবং কামালপন্থী বিরোধী রাজনৈতিক দল সিএইচপি-সহ (Cumhuriyet Halk Partisi Republican People's Party) দু’একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া তুরস্কের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আদালতের রায় ও সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন ও স্বাগত জানিয়েছে। সিএইচপি এর পক্ষ থেকে কোনো অফিসিয়াল বক্তব্য দেয়া হয়নি। তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যে, এ বিষয়ে বিরোধিতা করে সোচ্চার হওয়ার তাদের খুব বেশি অবকাশ নেই। অবশ্য সংখ্যায় কম হলেও তুর্কি জনমতের একটি অংশ মনে করে খ্রিষ্টান ও মুসলিম সংহতির প্রতীক হিসেবে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর হিসেবে রাখাই ভালো ছিল।

গ্রিস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু পশ্চিমা দেশ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। আয়া সোফিয়াকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যকার বাদানুবাদ ও কূটনৈতিক টানাপড়েন তুঙ্গে উঠেছে। অর্থোডস্ক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু প্যাট্রিয়ার্ক প্রথম বার্থোলোমিউ এবং ক্যাথলিক চার্চ এবং সার্বভৌম ভ্যাটিকান সিটি প্রধান পোপ ফ্রান্সিসও আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরে তুর্কি সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। স্থাপনাটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণাকারী ইউনেস্কোও এতে অসন্তোষ প্রকাশ ও এর প্রতিবাদ জানিয়েছে।

সরকারিভাবে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও সাধারণ মানুষ এমনকি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনা চলছে। তবে আয়া সোফিয়াকে ঘিরে আন্তর্জাতিক এসব সমালোচনাকে মোটে আমলে নিচ্ছে না প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তাঁর সরকার। উল্টো তুরস্কের অভ্যন্তরীণ এ বিষয়টি নিয়ে বহির্বিশ্বকে নাক গলাতে নিষেধ করেছে তুরস্ক। এ বিষয়ে সমালোচনাকে তুর্কি সরকার দেখছে তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে।

আয়া সোফিয়াকে কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষাপটে অনেকের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে এর ইতিহাস জানার ব্যাপারে। আর এ কারণেই বর্তমান নিবন্ধটির অবতারণা।

কনস্টান্টিনোপল হলো ইস্তাম্বুল

ভূমধ্যসাগরের চারিদিকে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার অংশ বিশেষ নিয়ে গড়ে ওঠা মহাপরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্য খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে পূর্ব ও পশ্চিম-এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশটি তখন গ্রিক বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নামে পরিচিতি লাভ করে। এ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল ঐতিহাসিক নগরী ‘কনস্টান্টিনোপল’। ৩৩০ খ্রি. বাইজান্টাইন সম্রাট কন্সটান্টাইন বসফোরাস প্রণালীর উপকূলবর্তী প্র্রাচীন গ্রিক শহর বাইজান্টিয়ামে একটি নতুন রাজধানী শহর নির্মাণ করে এর নাম দেন ‘নোভা রোমা’ বা নতুন রোম। উল্লেখ্য যে, অখ- রোমান সম্রাজ্যের রাজধানী ছিল রোম। খ্রি. পূ. ১০০-৪০০ খ্রিঃ পর্যন্ত রোম ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম নগরী। এ নগরীর স্মৃতি স্মরণেই সম্ভবত সম্রাট কনস্টান্টাইন তাঁর নব প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর নাম রেখে ছিলেন নোভা রোমা।

পরবর্তীকালে এ নামটি পরিবর্তন করা হয় এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্রাটের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘কনস্টান্টিনোপল’। কনস্টান্টিনোপল ছিল মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর অন্যতম। একে ইউরোপের প্রবেশদ্বারও বলা হয়। ফরাসি সম্রাট নেপালিয়নের চোখে ইস্তাম্বুল (ততদিনে কনস্টান্টিনোপলের নাম হয়ে গেছে ইস্তাম্বুল) ছিল পৃথিবীর সুন্দরতম নগরী। তিনি এ শহরের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, তিনি নাকি মনেপ্রাণে সব সময় স্বপ্ন দেখতেন প্যারিস নয়, ইস্তাম্বুলকে তিনি ফরাসি সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে অধিষ্ঠিত করবেন। তবে বিধি বাম, ওয়াটার লু যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজয়ের মতো এ ইস্তাম্বুলও তাঁর জীবনে অন্যতম ট্রাজেডিতেই পরিণত হয়েছিল।

অনন্য নগর পরিকল্পনা ছাড়াও অপরিসীম ভৌগলিক ও রণচাতুর্যিক অবস্থানের কারণে নেপোলিয়নের অনেক আগে থেকেই বিশ্বের ক্ষমতাধর শক্তিসমুহের এ নগরীটির প্রতি বিশেষ নজর ছিল। নগরীটির গুরুত্ব ও মুসলিম সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে খোলাফায়ে রাশেদুনের সময় থেকেই মুসলমানরা কনস্টানন্টিনোপল অধিকারে অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। তবে তাঁদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। অবশেষে পূর্বসূরীদের এ অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করেন উসমানী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ (তুর্কিদের কাছে যিনি মেহমেত নামে পরিচিত)।

১৪৫৩ সালে ৬ এপ্রিল তিনি কনস্টান্টিনোপল নগরী অবরোধ করেন এবং দীর্ঘ ৫৪ দিনের অবরোধ শেষে ২৯ মে কনস্টান্টিনোপল উসমানীয়দের পদানত হয়। মহান সম্রাট সিজারের পঞ্চান্নতম উত্তরপুরুষ এবং সম্রাট একাদশ কন্সটান্টাইন প্যালিওলোগাস রণক্ষেত্রে নিহত হলে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের নাটকীয় দৃশ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনের জন্য দ্বিতীয় মুহাম্মদকে ‘ফাতিহ’ (the Conqueror) উপাধি দ্বারা সম্মানিত করা হয়।

উসমানী সালতানাতের ইতিহাস রচয়িতা ঐতিহাসিকগণ বলেছেন যে, ত্রয়োদশ শতকের গোড়াতে অর্থোডক্স কনস্টান্টিনোপলের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পরিচালিত চতুর্থ ক্রুসেডের তুলনায় সুলতান ফাতিহর এ বিজয় ছিল অনেক বেশি মানবিক। কারণ বিজয়ী সুলতান ক্রুসেডারদের মতো পরাজিত শত্রুর বিরুদ্ধে হত্যাকা- ও বর্বরতার আশ্রয় নেননি। তিনি তাদের প্রতি উদার ও সহনশীল নীতি অবলম্বন করে তাদের চিত্ত জয়ের চেষ্টা করেন। বিজয়ী উসমানী শক্তির ভয়ে যেন অধিবাসীরা নগরী ত্যাগ না করেন সে জন্য সুলতান সকলকেই অভয়দান করেন।

গ্রিক চার্চের গোঁড়া খ্রিস্টানদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সুলতান যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে গেন্নিদিয়াস নামে একজন গ্রিক প্যাট্রিয়ার্ককে (অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের ধর্মীয় পুরোহিত) কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু নির্বাচন করেন এবং সুলতান স্বয়ং নিজেকে খ্রিস্টান ধর্মের রক্ষক হিসেবে ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয়, আনুষ্ঠানিক সনদের মাধ্যমে সুলতান কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের সম্পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান এবং পুরোহিতসহ সকল ধর্মযাজকদের কর মওকুফ করে দেন।

দ্বিতীয় মুহাম্মদ একজন দুরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। কনস্টান্টিনোপল নগরীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি একে উসমানী সালতানাতের রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেন। রাজধানীর উপযোগী করার জন্য সুলতান নগরীটির সংস্কারসহ শ্রীবৃদ্ধিমূলক নানা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কনস্টান্টিনোপল থেকে নগরীর নতুন নামকরণ করা হয় ‘ইস্তাম্বুল’। যা হোক- এ ভাবেই গ্রিক বাইজান্টানইন রাজধানীটি নতুন নামে উসমানীদের রাজধানীতে পরিণত হয়। যুদ্ধে খ্রিষ্টানদের মৃত্যু এবং বিজয় পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টানদের অনেকে অনত্র চলে যাওয়ায় নগরের জনসংখ্যা কমে যায়। সুলতান রোমেলি ও আনাতোলিয়া থেকে বহু নাগরিক এনে তাদেরকে ইস্তাম্বুলে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এটি মুসলমানদের ধর্মীয়-রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক খিলাফতেরও কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ২০১০ সালে ইউনেসকো ঘোষিত পৃথিবীর কালচারাল ক্যাপিটালের মর্যাদা লাভ করে ইস্তাম্বুল।

আয়া সোফিয়া গির্জা

ইস্তাম্বুল নগরীটি দু’টিভাগে বিভক্ত। ইউরোপীয় অংশ ও এশিয় অংশ। ইউরোপীয় অংশের ফাতিহ নামক এলাকাতেই জগৎবিখ্যাত ‘আয়া সোফিয়া’, ‘হায়া সোফিয়া’ বা ‘হাগিয়া সোফিয়া’ (গ্রিক ভাষায় -Ἁγία Σοφία), লাতিন ভাষায় -Sancta Sophia বা Sancta Sapientia এবং তুর্কি ভাষায়- Ayasofya) নামক স্থাপত্য কীর্তিটি অবস্থিত। আয়া সোফিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান। তাঁর নির্দেশে অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চ হিসেবে ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তা শেষ হয়। সে সময় এটি ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম স্থাপত্য ইমারত।

এর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, It is considered the epitome of Byzantine architecture and is said to have ‘changed the history of architecture’. উল্লেখ্য যে, গ্রিক পুরাণ মতে, ‘সোফিয়া’ হচ্ছেন জ্ঞানের দেবী। আর গ্রিক ভাষার ‘আয়া সোফিয়া’কে অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ঐড়ষু Holy Wisdom বা ‘পবিত্র জ্ঞান’। নির্মাণের পর থেকে এটি অর্থোডস্ক গির্জা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের মাধ্যমে ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। বিজয়ী শক্তি অর্থোডস্ক চার্চ আয়া সোফিয়াকে ‘ক্যাথলিক চার্চে’ রূপান্তরিত করে।

অবশ্য ১২৬১ খ্রিস্টাব্দে ক্যাথলিকদের পরাজয়ের ফলে আয়া সোফিয়া আবারো অর্থোডক্স গির্জায় রূপান্তরিত হয়। আর তা ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত এতে অর্থোডক্সদের উপাসনা চলে। এভাবে মাঝখানে ৫৭ বছরের সাময়িক বিরতি ছাড়া প্রায় একহাজার বছর আয়া সোফিয়া ছিল পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং এটিই ছিল তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা। আয়া সোফিয়া কেবল ধর্মীয় তীর্থস্থান নয়, এটি বাইজান্টাইনদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্রও ছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাটদের রাজ্যাভিষেকসহ বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানের কাজেও আয়া সোফিয়াকে ব্যবহার করা হতো। বাইজেনটাইন রাজাদের রাজমুকুটও এখানে সংরক্ষিত থাকতো।

মসজিদ হলো আয়া সোফিয়া

সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ ইস্তাম্বুলে অবস্থিত বিখ্যাত ‘আয়া সোফিয়া গির্জা’-টিকে মসজিদে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেন। কারো কারো মতে, এর জন্য তিনি বলপ্রয়োগে গির্জাটি দখল করে নিয়েছিলেন। তবে এমতের পক্ষে প্রামাণিক দলিল নেই। এ বিষয়ে ভিন্ন মতটি হলো, মসজিদের রূপান্তরের জন্য সুলতান খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতাদের কাছে ব্যক্তিগত অর্থে গির্জাটি কিনে নিয়েছিলেন। খ্রিষ্টান ধর্মগুরুগণ কেন এটি বিক্রি করেছিলেন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, অর্থলিপ্সার কারণেই তাঁরা সুলতানের এ প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন। আবার অনেকে মনে করেন যে, ধর্মীয়ভাবে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় প্রান্তিক হয়ে পড়ার কারণে এত বড় গির্জা রাখার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

আগেই বলা হয়েছে যে, যুদ্ধে নিহত ও বাস্তুত্যাগের ফলে ইতোমধ্যে ইস্তাম্বুলে খ্রিষ্টানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে পড়েছিল। কারণ যাই হোক না কেন তৎকালীন খ্রিষ্টান নেতারা আয়া সোফিয়া বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এবার তুর্কি সরকার সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদের কিনে নেয়ার ভাউচার বিল প্রকাশ করেছেন। তুর্কি গণমাধ্যমের পাশাপাশি আল জাজিরা টিভিতেও তা প্রদর্শন করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, গির্জা বিক্রির ঘটনা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ ইউরোপ আমেরিকাতেও এখনো হচ্ছে। আর এসব গির্জার স্থাপনা ক্রয় করে নিয়ে পরে সেগুলো মসজিদে রূপান্তরও করা হচ্ছে।

আয়া সোফিয়া খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে ক্রয় করার পর সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ সেখানে একটি ওয়াকফ এসোসিয়েশন গঠন করেন এবং আয়া সোফিয়া ভবনটিকে তাদের মালিকানায় দান করে দেন। এ সংক্রান্ত ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানার মূল দলিলটিও তুর্কি সরকার গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। যা হোক, সুলতানের নির্দেশে তাঁর ক্রয়কৃত আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। আয়া সোফিয়ার শীর্ষদেশে ক্রস চিহ্নের পরিবর্তে চাঁদ তারা খচিত উসমানীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ ভাবেই বাইজান্টাইন অর্থোডক্স গির্জাটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়।

সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ আয়া সোফিয়ার সংস্কার এবং স্থাপনাটিতে চারটি মিনার সংযুক্ত করেন। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে দ্বিতীয় সুলতান সেলিমের শাসনামলে আয়া সোফিয়া মসজিদের বহিরাবরণকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হয়। এই কাজের দায়িত্ব পান তৎকালীন বিখ্যাত স্থাপত্যশিল্পী মিমার সিনান। ইতিহাসে সিনান ছিলেন প্রথম স্থাপত্যশিল্পী যিনি তাঁর নির্মিত স্থাপনাগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষম করে তৈরি করেছিলেন। আয়া সোফিয়া মসজিদকেও একই বৈশিষ্ট্য দেয়ার পর তিনি মসজিদের পশ্চিম পার্শ্বে আরো দু’টি মিনার সংযোজন করেন। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের সময়ই আয়া সোফিয়াকে Imperial Mosque এ পরিণত করা হয়েছিল। ১৬১৭ সালে Blue Mosque বা ‘সুলতান আহমেদ মসজিদ’ নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটিই ছিল ইস্তাম্বুলের প্রধান মসজিদ।

প্রধান রাজকীয় মসজিদের মর্যাদা হারালেও আয়া সোফিয়া মসজিদের উন্নয়নে পরবর্তীকালে অনেক সুলতান অবদান রেখেছেন। বিভিন্ন সময়ের সংস্কারে মসজিদটিতে সংযোজন করা হয় সুলতানের জন্য বসার জায়গা, মর্মর পাথরে তৈরি মিম্বার এবং মুয়াজ্জিনের জন্য একটি ছাদযুক্ত বারান্দা। ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আয়া সোফিয়া মসজিদে একটি মাদ্রাসা সংযোজন করা হয়, যেটি বর্তমানে লাইব্রেরিতে রূপ নিয়েছে। এই লাইব্রেরিতে রয়েছে তিন লাখেরও বেশি মূলবান গ্রন্থ।

এই মসজিদে সবচেয়ে ব্যাপকভিত্তিক মেরামত ও পুনর্নির্মাণ কাজ হয় ১৮৪৮ ও ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে। এসময় মসজিদের পিলারগুলোতে বিশাল বিশাল গোলাকৃতি ফলক ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এসব ফলকে শোভা পায় আল্লাহ তায়ালার গুণবাচক নাম। পাশাপাশি বিশ্বনবী (সা.), হজরত আবুবকর (রা.) হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.), হজরত আলী (রা.), ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসেইন (রা.) এর নামও এসব ফলকে স্থাপন পায়।

উসমানী স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসেও আয়া সোফিয়ার প্রভাব সুস্পষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, উসমানীয়রা আয়া সোফিয়াকে নিজের মতো আপন করে নিয়েছিল। আর এ কারণেই উসমানী আমলে স্থাপিত সব মসজিদ ও স্থাপনায় আয়া সোফিয়ার গর্বিত উপস্থিতি দেখা যায়। উসমানীয় মসজিদগুলোর গম্বুজ আয়া সোফিয়ার গম্বুজের মতো করেই তৈরি হয়েছে, যা সম্পূর্ণভাবেই আরব বিশ্বের মসজিদের গঠন থেকে আলাদা। এক কথায়, পুরো উসমানী সভ্যতার স্থাপত্যবিদ্যা আয়া সোফিয়াকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। John Freely এর History of Ottoman Architecture গ্রন্থে এতদবিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তর

১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে উসমান আততুগ্রুল যে উসমানী সালতানাতের পত্তন করেছিলেন উনিশ শতকের মধ্যভাগে নানা কারণে তা ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তির’ খেতাব লাভ করে এবং এ শতকেরই শেষ দিকে পাশ্চাত্যপন্থী ও জাতীয়তাবাদী বলে কথিত তুৃর্কিরা জাতির মুক্তির লক্ষ্যে এ উসমানী সালতানাত উচ্ছেদের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাঁদের প্রচেষ্টা সফল হয়। মুস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী তুর্কিরা ১৯২৩ সালে উসমানী সালতানাত উচ্ছেদ করে এবং তদস্থলে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। মুস্তফা কামাল পাশা তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

তিনি সনাতন প্রাচ্য ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ মূল্যবোধ পরিত্যাগ করে তুরস্ককে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ উদ্যোগ হিসেবে ১৯২৪ সালে খিলাফত ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন করেন এবং ১৯২৮ সালে সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম-এ ধারাটি বাতিল করে তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ইসলাম ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালনের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সরকারি নির্দেশে অনেক মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৪ সালে প্রেসিডেন্টের এক নির্বাহী আদেশে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করায় হয়। ফলে ৪৮২ বছর ধরে মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত আয়া সোফিয়ায় নামাজ ও আজান বন্ধ হয়ে যায়। দর্শনীর বিনিময়ে সাধারণ মানুষের পরিদর্শনের জন্য জাদুঘরটি উন্মুক্ত করা হয়। এক সময় এই ইউনেস্কো আয়াসোফিয়াকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৮ সালের জুন মাসে নিবন্ধকার নিজে ৬০ লিরায় টিকেট কেটে আয়া সোফিয়া পরিদর্শন করেছেন।

আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে পরিণত করার পেছনে মুস্তফা কামালের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান, ধর্মীয় শিক্ষা ও উপসনালয় বন্ধ করে পশ্চিমা ধাঁচের ধর্মনিরপেক্ষতা চালুর মাধ্যমে তিনি নিজেকে ও তুরস্ককে ইউরোপীয় সমাজের অংশ করতে চেয়েছিলেন।

প্রতীক্ষার ৮৬ বছর

আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরের রূপান্তরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে টানাপোড়েন চলেছে৷ তুরস্কে ডান এবং ইসলামপন্থীরা আয়া সোফিয়াকে সবসময় উসমানী তথা ইস্তান্বুল বিজয়ের নিদর্শন মনে করে আসছে। তাই একে জাদুঘরে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত তারা কখনই মেনে নেয়নি। আতাতুর্কের সময় থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। তুর্কি জনমতের একটি অংশ একে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের দাবি করে এসেছে। তুরস্কে ইসলামী জাগরণের অন্যতম কবি নাজিব ফাজিল কিসাকোরেক ও প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান প্রমুখ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের দাবির পক্ষে তুর্কিদের সংগঠিত করেছেন।

অন্যদিকে কামালপন্থী সেক্যুলার দলগুলো সর্বদাই তুরস্কের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখার কথা বলে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর হিসেবে রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে কাজ করেছেন। এভাবেই চলে যায় অনেক দিন। ইসলামপন্থী একে পার্টি (Adalet ve Kalkınma Partisi- Justice and Development Party) ক্ষমতায় আসার পর ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের দাবিতে মামলা করা হয়। মামলার মুল বাদী ছিল Permanent Foundation Service to Historical Artifacts and Environment Association নামক একটি সংগঠন। তবে বেশকিছু সিভিল সোসাইটি এ মামলা পরিচালনায় সহায়তা করেছিল।

মামলার আর্জিতে বলা হয়েছিল- আয়া সোফিয়া একটি ওয়াকফ সম্পত্তি। এটি সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ ব্যক্তিগত অর্থে ক্রয় করে মসজিদের জন্য ওয়াকফ করেছিলেন। সুতারং দাতা যে কাজের জন্য এটি ওয়াকফ করেছেন, এর বাইরে অন্য কাজে এটির ব্যবহার আইনসঙ্গত নয়। তিন বছর মামলাটি চলার পর ২০০৮ সালে আদালত এ মামলাটি খারিজ করে দেয়।

মামলা খারিজ হয়ে গেলেও বাদীপক্ষ থেমে থাকেনি। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের পক্ষে জনমত তৈরির অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তাদের অব্যহত প্রয়াসের ফলে এ দাবির পক্ষে অন্ততঃ ৭০% তুর্কি ইতিবাচক জনমত দিয়েছে বলে দাবি করা হয়। রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে সেক্যুলার দলগুলোও তাদের কণ্ঠ নরম করে ফেলে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বরাবরই আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের পক্ষে ছিলেন। ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র থাকা অবস্থায় প্রাকাশ্যতই এ কথা বলেছেন। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাাচনের পূর্বে এটি ছিল তাঁর অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।

উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। কোনো স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি কখনো তাড়াহুড়া করেন না। বরং সময় নিয়ে তাঁর কাঙ্ক্ষিত পরিকল্পনার পক্ষে জনমত ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তারপর সুযোগ বুঝে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এক্ষত্রেও তিনি তাই করেছেন। প্রয়োজনীয় জনমত সৃষ্টির পর তাঁর আশির্বাদপুষ্ঠ পূর্বোক্ত সংগঠনটি আবারো আদালতের শরণাপন্ন হয়। গত ২ জুলাই আদালতে এ ব্যাপারে শুনানী হয়। শুনানীতে বাদীপক্ষ সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদের ওয়াকফ দলিল ও ক্রয়ের রশীদসহ প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি আদালতে পেশ করে।

শুধু তাই নয়, একে জাদুঘরে রুপান্তর বিষয়ে প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের নিবার্হী আদেশের কিছু অসঙ্গতিও আদালতে উপস্থাপন করা হয়। শুনানীর পর আদালত গত ১০ জুলাই এক ঐতিহাসিক রায়ে বলে যে, ‘১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার যে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদ থেকে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, তা আইন মেনে করা হয়নি।’ অতএব আদালত ঐ আদেশ বাতিল করে আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তর করার আদেশ দেয়। ওই দিনই দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের ডিক্রিতে সই করেন। আয়া সোফিয়ার সম্পত্তি জাদুঘর দপ্তর থেকে ‘দিয়ামাত’ বা তুরস্কের ধর্ম বিষয়ক দফতরের হাতে সোপর্দ করা হবে বলেও প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন। আগামী ২৪ জুলাই তারিখে নামাজের জন্য আয়া সোফিয়াকে খুলে দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আয়া সোফিয়ার ভেতরে গির্জা ও মসজিদ, ইউরোপীয় ও উসমানী উভয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যিক নিদর্শন রয়েছে। আশাঙ্কা করা হয়েছিল যে, মসজিদে পুনঃরূপান্তরের ফলে আয়া সোফিয়ার দ্বার অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন আয়া সোফিয়ার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন বলেন, আয়া সোফিয়া নামাজের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় এটি তার পরিচয় থেকে বঞ্চিত হবে না। বরং স্থাপনাটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য সুরক্ষিত রাখা হবে।

ভেতরের বিভিন্ন চিত্রকলার মোজাইকগুলো নামাজের সময় পর্দা বা লেজার রশ্মি দিয়ে ঢেকে রাখা হবে বলে জানিয়েছে দেশটির ক্ষমতাসীন একে পার্টির মুখপাত্র ওমর চেলিক। তিনি বলেন, খ্রিস্টানদের যেসব নিদর্শন রয়েছে সেগুলো নামাজের সময় ছাড়া অন্যান্য সময় দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখা হবে। তবে জাদুঘর পরিদর্শনে টাকা লাগলেও এখন থেকে আয়া সোফিয়ায় প্রবেশে কোন টাকা লাগবে না।

অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তর নিয়ে তুরস্কের অভ্যন্তরে ও বৈশ্বিক পরিম-লে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ তুর্কি জনমত ও প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন ও স্বাগত জানিয়েছে। সংখ্যায় কম হলেও তুর্কি জনমতের একটি অংশ বিশেষ করে কামালপন্থী সেক্যুলাররা এ সিদ্ধান্তকে তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলে মনে করছেন। নোবেল জয়ী তুর্কি সাহিত্যিক অরহান পামুক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক নিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের যে গর্ব ছিল, তা ধসে গেল।’

গ্রিস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কিছু পশ্চিমা দেশ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনরূপান্তরের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইউনেস্কোও এটি মেনে নিতে পারছেনা। অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা, এমনকি পোপ ফ্রান্সিসও এতে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। প্রতিবাদকারীরা মনে করেন যে, এর ফলে মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদাযের মধ্যে বিভক্তি ও অনৈক্য বৃদ্ধি পাবে।

তুর্কি সরকারের অবস্থান

তবে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বিরোধিতা ও সমালোচনাকে একেবারেই আমলে নিচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তাঁর সরকার। তুর্কি সরকারের মতে, আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের বিষয়টি একান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের খবরদারিকে তুরস্ক তার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের নামান্তর বলে মনে করছে। তাই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তুর্কি বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নাক না গলানোর জন্য সবাইকে আহবান জানানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এরদোয়ান বিরোধিতাকারীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, স্পেনেওতো অনেক মসজিদকে পরবর্তীতে গির্জা বানিয়েছে খ্রিস্টান শাসকরা। তিনি বলেন, পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের অজুহাতে নিহত হচ্ছে এবং অসংখ্য মানুষ নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। আমাদের উচিত আগে সেগুলো বন্ধ করা।। ইতোমধ্যে রাশিয়া একে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মেনে নিয়ে তুর্কি উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

তুরস্কের ভবিষ্যৎ

আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের ফলে তুরস্কের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশটির অবস্থান কী হবে? এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হবে? এসব নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে চলছে নানা বিচার-বিশ্লেষণ। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি এরদোয়ানের একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে কেবল তুরস্ক নয় মুসলিম বিশ্বকেও দীর্ঘ মেয়াদী মাসুল দিতে হবে। পশ্চিমা বিরোধিতার দরুন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আঙ্কারা আরও বেশি নিঃসঙ্গ হতে পারে। তুরস্কের আর্থিক ও পর্যটন খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।

আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের এরদোয়ানের উদ্দেশ্য নিয়েও চলছে নানা রকম বিশ্লেষণ। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন যে, বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এরদোয়নকে এই সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেছে। যেমন তুরস্কের আগামী নির্বাচনে রক্ষণশীল ভোট ব্যাংকের সমর্থন নিশ্চিত করা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের The Deal of the Century শান্তি পরিকল্পনার নামে জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয়ার জবাব দান; বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোতে চীন ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান নীতিনির্ধারণী অবস্থান এবং ব্রেক্সিট, উগ্র ডানপন্থীদের উদয়, করোনা মহামারি এবং মার্কিনদের একলা চলো নীতি ইত্যাদির ফলে পশ্চিমা বিশ্বের একক ক্ষমতাচর্চায় সীমাবদ্ধতা তৈরির সুযোগের সদ্ব্যবহার ইত্যাদি।

দীর্ঘ পরিবর্তনের পরিক্রমায় আয়া সোফিয়া ৮৬৯ বছর অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের চার্চ, ৫৭ বছর ক্যাথলিক খিস্টানদের চার্চ, ৪৮২ বছর মসজিদ এবং ৮৬ বছর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গত ১০ জুলাই আয়া সোফিয়ার সুউচ্চ মিনার থেকে আবার আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের ফল ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বা তুরস্কের জন্য কেমন হবে? শুভ নাকি অশুভ? এ প্রশ্নের চূড়ান্ত জবাব দেয়ার এখনো সময় আসেনি। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কতটা বিচক্ষনতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবেন, তুর্কি জনমত তাঁকে কতটা সমর্থন জানাবে এবং সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বসহ এরদোয়ানের বিশ্বমিত্ররা এ প্রশ্নে কীভাবে তাঁর পাশে থাকবে, এর ওপরই নির্ভর করছে এরদোয়ান ও তুরস্কের ভবিষ্যৎ।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়