ডেক্সামেথাসোন স্টেরয়েড ওষুধ করোনা চিকিৎসায় কতটা কার্যকর?

জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসএসই) প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ ৭৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে ও মৃতের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যে গত মার্চ মাসে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় "The RECOVERY trial" নামক বিশ্বের অন্ততম বৃহত্তম রেন্ডোমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালস করা হয়েছিল।

"The RECOVERY trial" এ ডেক্সামেথাসোন নামে প্রদাহনাশক এক স্টেরয়েড ওষুধকে ২ হাজার ১ শত করোনা আক্রান্ত রোগীর উপর ট্যাবলেট হিসেবে মুখ দিয়ে প্রয়োগ করা হয়েছিল (তথ্যসূত্রঃ ২৫ জুন ২০২০ তারিখের "ন্যাচার" জার্নাল")। উক্ত ট্রায়ালে প্রতিদিন ৬ মিলিগ্রাম করে ১০ দিন রোগীদের ডেক্সামেথাসোন ডোজ দেওয়া হয়েছিল এবং ৪ হাজার ৩ শত রোগীকে কোন ওষুধ ছাড়াই কোভিড-১৯ রোগের স্টাডার্ড কেয়ারে রাখা হয়েছিল।

"The RECOVERY trial" এ ডেক্সামেথাসোন এর প্রতিক্রিয়া হাসপাতালে থাকা মারাত্মক অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য দারুণ কার্যকর এক চিকিৎসা হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে, বিশেষভাবে যারা ভেন্টিলেশনে ছিলেন (কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন গ্রহণ করেছেন)। যে বিজ্ঞানীরা ডেক্সামেথাসোন এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যুক্ত ছিলেন, তারা জানিয়েছেন যে, ভেন্টিলেশনে থাকা এক তৃতীয়াংশের মৃত্যু ঠেকাতে সক্ষম এই ওষুধ। মারাত্মক অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীদের যারা হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে ছিলেন না, তাঁদের মৃত্যুহার ২০% কমে গিয়েছিল। যাদের মৃদু উপসর্গ ছিল তাদের জন্য এই ওষুধ কার্যকর হয় নি (তথ্যসূত্রঃ ২৫ জুন ২০২০ তারিখের "ন্যাচার" জার্নাল")।

কোভিড-১৯ রোগের জন্য নভেল করোনাভাইরাস সার্স-কোভ-২ প্রথমে মানুষের নাক ও গলায় সংক্রমণ ঘটায়। যদি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাথমিক অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাসকে (SARS-CoV-2) প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তখন ভাইরাস বলিষ্ঠভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করতে শ্বাসনালী দিয়ে নিম্নমুখে অগ্রসর হয়। ভাইরাস ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোর বাহিরের আবরণে এক স্তরের "এপিথেলিয়াল কোষে" সমৃদ্ধ এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) রিসেপটরে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে ফুসফুস আক্রমণ করে (তথ্যসূত্রঃ ৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ)। ভাইরাস ফুসফুসে প্রবেশের পর ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দূর্বল করে কোষগুলোকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে।

ফুসফুস করোনাভাইরাস দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সময় দেহের শ্বেত রক্ত কণিকা (white blood cells) কেমোকাইন (Chemokine) নামক জৈব পদার্থকে উন্মুক্ত করে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")। কেমোকাইন হচ্ছে এক ধরণের সিগন্যালিং প্রোটিন যা দেহের ক্ষতের নিরাময়ের সময়ে (রক্ত জমাট প্রক্রিয়া, নতুন কোষ তৈরি) ও রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরণের কোষ থেকে নিঃসৃত হয়। নতুন কেমোকাইন আরোও অধিক পরিমানে দেহের রোগ প্রতিরোধী কোষকে জড়ো করে যা ভাইরাস আক্রান্ত ফুসফুসের কোষগুলোকে মেরে ফেলে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")। এ কারণে সৃষ্ট তরল ও মৃত কোষগুলি পুঁজে পরিণত হয়। এটি হচ্ছে কোভিড-১৯ রোগের ফলে সৃষ্ট নিউমোনিয়া (ফুসফুসে প্রদাহ)। ফলে শ্বাসকষ্ট হয়।

কোভিড-১৯ মারাত্মকভাবে আক্রান্তের দেহে অতিরিক্ত সৃষ্ট "কেমোকাইন" রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন ছাড়াও, ক্ষতের সময় হেমোস্ট্যাসিস (Hemostasis) পর্যায়ে রক্ত জমাটে (ব্লাড ক্লট) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে (তথ্যসূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মোলিকুলার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ)। অতিরিক্ত "কেমোকাইন" তৈরির মাধ্যমে মানবদেহে ভাইরাস সংক্রমণ রোধের প্রক্রিয়া, রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে অধিকতর সক্রিয় করে।

দেহের অন্য জায়গার রক্ত জমাটগুলো ফুসফুসের মূল ধমনিগুলোতে (রক্তনালী) জমা হয়ে ধমনিগুলো ব্লক করে; যাকে পালমোনারি এমবোলিজম (Pulmonary embolism) বলা হয়। নিউমোনিয়ার মারাত্মক পর্যায়ে ভাইরাসের তীব্র সংক্রমণের কারণে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলো শ্লেষ্মা, রক্তের শ্বেত কণিকা, তরল পদার্থ ও ফুসফুসের ধ্বংসপ্রাপ্ত কোষের রাবিশ দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়। একারণে শ্বাসকষ্ট আরোও মারাত্মক হয়। নিউইয়র্কের আপস্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও ক্রাউস হেলথের ফুসফুস জটিল রোগ বিশেষজ্ঞ ড. ভিরেন কাউর বলেন, ভাইরাস কোভিড-১৯ রোগীর ফুসফুসে চাপ ও মারাত্মক প্রদাহের সৃষ্টি করে, যা রোগীর দেহে রক্ত জমাটে (ব্লাড ক্লট) প্ররোচিত করে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম এবিসি নিউজ)।

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন প্রদাহ তৈরি হয়। মাঝে মাঝে এই লড়াই তীব্র হয়ে ওঠে এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ফুসফুসের কোষগুলো আক্রমণের শিকার হয়। ফলাফল হিসেবে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শ্লথ করার মাধ্যমে ডেক্সামেথাসোন এই প্রতিক্রিয়াকে প্রশমন করে। নতুন কেমোকাইন আরোও অধিক পরিমানে দেহের রোগ প্রতিরোধী কোষকে জড়ো করে ভাইরাস আক্রান্ত ফুসফুসের কোষগুলোকে মেরে ফেলার সময় অতি সক্রিয় কেমোকাইনকে রোধ করার মাধ্যমে ডেক্সামেথাসোন মারাত্মক শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুসকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ডেক্সামেথাসোন শুধুমাত্র তাদের জন্যই উপযুক্ত, যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন এবং কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন গ্রহণ করছেন বা ভেন্টিলেশনে রয়েছেন - অর্থাৎ মারাত্মকভাবে অসুস্থ যারা। যাদের মৃদু উপসর্গ রয়েছে তাদের জন্য এই ওষুধ কার্যকর নয়। বরং ডেক্সামেথাসোন মৃদু উপসর্গ থাকা রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শ্লথ করে দিয়ে ক্ষতির কারণ হবে কারণ এ পর্যায়ে কোভিড-১৯ রোগ থেকে আরোগ্য লাভে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সর্বোচ্চ কার্যকারিতা জরুরী।

যুক্তরাজ্যের কোভিড-১৯ থেরাপিউটিকস এক্সিলেটর এর প্রধান নিক ক্যামাক বলেছেন যে, "The RECOVERY trial" স্ট্যাডিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডেক্সামেথাসোন এর প্রয়োগে শুধুমাত্র মারাত্মক রোগীরা উপকৃত হলেও, বিশ্বে অসংখ্য জীবন রক্ষা পাবে। এর ফলাফল প্রকাশের পরপরই যুক্তরাজ্য সরকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ভেন্টিলেটরে থাকা কোভিড-১৯ মারাত্মক রোগীদের জন্য ডেক্সামেথাসোন এর ব্যবহার অনুমোদন দিয়েছেন। সুখের বিষয়, ডেক্সামেথাসোন ব্যয়বহুল নয় এবং সহজলভ্য। বিশ্বের সকল দেশের ফার্মেসিতে এই কমন স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসোন সহজেই পাওয়া যায়।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়