গৃহহীনের ঘরের টাকায় জমি কিনলেন ইউএনও!

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে বর্তমানে গৃহহীনদের জন্য দুর্যোগসহনীয় গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কাবিটা (গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার) ও টিআর (গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ) কর্মসূচির বিশেষ খাতের অর্থ দিয়ে কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলায় গত ও চলতি অর্থবছরে ১২৪টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় দুই লাখ ৫৮ হাজার থেকে দুই লাখ ৯৯ হাজার টাকা। এসব ঘরের তালিকা তৈরি ও গৃহ নির্মাণ করে দেন রাজীবপুরের সদ্য বদলি হয়ে যাওয়া ইউএনও মেহেদী হাসান। মেম্বার-চেয়ারম্যানদের না জানিয়ে তাঁদের নামে গৃহ নির্মাণ প্রকল্প দেখিয়ে বরাদ্দকৃত সব গৃহ নির্মাণ বাস্তবায়ন দেখিয়ে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন তিনি। গৃহ নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে ওই বাণিজ্য করেন বলে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন।

শুক্রবার উপজেলার তিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, বদলি হওয়া ইউএনও ঠাকুরগাঁওয়ে মেইন রাস্তার সঙ্গে বাড়ি করার জন্য গৃহহীনের টাকা দিয়ে কোটি টাকা খরচ করে জমি কিনেছেন। রাজীবপুরের ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গৃহহীনদের ঠকিয়ে অবৈধভাবে ওই টাকা তিনি নিয়ে গেছেন। সদর ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল আলম বাদল বলেন, ‘১৭ মে তাঁকে রাজীবপুর থেকে অবমুক্ত করা হলেও তিনি এখানে থেকে আগের তারিখে অনেক ফাইলে স্বাক্ষর করে টাকা তুলে কাউকে না জানিয়ে জুমার নামাজের আগে বৃষ্টির মধ্যে রাজীবপুর ছেড়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া গৃহহীনদের টাকা তিনি ভুয়া বিল-ভাউচারে তুলে নিয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। এমন চারটি পরিবার রয়েছে যাঁদের নামে ঘর নির্মাণ দেখানো হয়েছে কিন্তু বাস্তবে তাঁদের বাড়িতে ঘর ওঠেনি। আমি এ বিষয়ে তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’

এদিকে ইউএনওর ওই সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার রাজীবপুর উপজেলা চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসী। উপজেলা ভূমিহীন সংগঠনের উদ্যোগে ওই মানববন্ধন কর্মসূচিতে ইউএনওর নানা দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বক্তব্য দেন ভূমিহীন নেত্রী হাফিজা বেগম, আব্দুর রশীদ, ফুল মিয়াসহ অনেকেই।

সদর ইউনিয়নের সদস্য ইসমাইল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার নামে গৃহ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে অথচ আমি কিছুই জানি না। আমার নামে ১৬ লাখ টাকার বিল তোলা হয়েছে।’ একই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বাদশা মিয়া ও আবু বক্কর অভিযোগ করেন, গত ১৫ জানুয়ারি আমাদের নামের ছয় লাখ টাকা সোনালী ব্যাংক থেকে তোলা হয়। আব্দুল বারী নামে আরেক সদস্য বলেন, ‘আমার নামে গৃহ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে কয়েক দফায় ২০ লাখ টাকার বিল তোলা হয়েছে। ইউএনও তাঁর লোক দিয়ে ওই টাকা তুলে নিয়েছেন।’ সদর ইউনিয়নের সদস্যরা অভিযোগ করেন, ‘আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে কোটি টাকার ব্যবসা করেছেন ইউএনও। নির্মাণ করে দেওয়া ঘরগুলো এক মাসেই ফেটে-ভেঙে যাচ্ছে। খুবই নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় এমনটা হয়েছে।’

কোদালকাটি ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির ছক্কু অভিযোগ করেন কুড়িগ্রামের প্রত্যাহার হওয়া ডিসি সুলতানা পারভীনের প্রভাব খাটিয়ে ইউএনও ওই দুর্নীতি করেছেন। তিনি নিজেই ঠিকাদার সেজে তাঁর নিজের এলাকার মিস্ত্রি ও নির্মাণ শ্রমিকদের রাজীবপুরে এসে নিম্নমানের কাজ করেন। যার বাড়িতে ঘর দেওয়া হয়েছে তার কাছ থেকে নির্মাণ শ্রমিকদের খাবারের ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের খরচও আদায় করেন ওই ইউএনও। একই ধরনের অভিযোগ করেন মোহনগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররাও।

রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কাবিটা (গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার) ও টিআর (গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ) কর্মসূচির বিশেষ খাতের অর্থ দিয়ে গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৫৫টি এবং চলতি অর্থবছরে ৬৯টি বরাদ্দ পাওয়া যায়। সব ঘর নির্মাণ বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা অনুসারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমে ঘরগুলো নির্মাণ করে দেওয়ার কথা থাকলেও ইউএনও তা করেননি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজিজুর রহমান বলেন, ‘গৃহ নির্মাণ কাজগুলো ইউএনও স্যার একা করছেন। আমাকে বিল-ভাউচারে স্বাক্ষর দিতে বলেছেস আমি দিয়েছি। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’

অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও মেহেদী হাসান বলেন, ‘চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ঘর নির্মাণের দায়িত্ব দিলে তাঁরা দুর্নীতি করতেন। এ কারণে ঘরগুলো আমি এবং আমার নিজস্ব কিছু লোক দ্বারা করে দিয়েছি।’ নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো বাণিজ্য করিনি। তালিকায় নাম রয়েছে কিন্তু ঘর নেই—এমন কয়েকজনের স্বজনদের বাড়িতে ওই ঘর করে দেওয়া হয়েছে।’ (সূত্র: কালেরকণ্ঠ)