‘টেলিভিশন ক্লাস ধনীদের, আমাগো না’

অন্যের বাসায় কাজ করে সংসার চলে দুই সন্তানের জননী নাছিমা বেগমের (৩৮)। রাজধানীর জুরাইনের এই বাসিন্দার বড় সন্তান সপ্তম শ্রেণিতে এবং ছোটটা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। করোনার এই পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকাতে টেলিভিশেনে ক্লাস নেওয়া প্রসঙ্গে তার অভিমত, ‘অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানোই কষ্টকর। এমনিতে সন্তানদের কোচিংয়ে দেয়ার মতো সামর্থ্য নেই। আর টিভিতে ক্লাস তো দূরের কথা। যারা ধনী তাদের জন্য ওইসব ক্লাস।’

বাংলাদেশে একটা সময় স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক ছিল। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, দারিদ্র্য পীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং ও মিড ডে মিল, উপবৃত্তি প্রদানসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় ঝরে পড়ার হার দিন দিন কমে আসছে।

করোনাভাইরাস মহামারিতে চলমান সংসদ টেলিভিশনে ক্লাসের সুবিধা পাচ্ছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। তবে ক্লাস করা থেকে বঞ্চিত হয়ে হতাশায় ভুগছে নিম্নবিত্ত কিংবা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শিক্ষার্থীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিম্নবিত্ত কিংবা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী অধিকাংশ পরিবারে টেলিভিশন নেই। আর এই মহামারীতে টেলিভিশন কিনে সন্তানদের ক্লাসের সুবিধা করে দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। এর ফলে টেলিভিশনে পাঠদানের সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, করোনা ভাইরাসে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকার গত ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। কয়েক দফায় ছুটি বাড়িয়ে সর্বশেষ সেটি ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই ছুটি গড়াতে পারে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত— এমন ইঙ্গিত দিয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীই।

এই দীর্ঘমেয়াদী ছুটির কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে সারা দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। একইভাবে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ধারাবাহিকতা রাখতে মাধ্যমিকের পর গত ৭ এপ্রিল থেকে প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাসও সংসদ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হচ্ছে।

তবে নিম্নবিত্ত কিংবা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শিক্ষার্থীরা টেলিভিশনে পাঠদানের কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। কারণ সংসদ টিভি দেখার সুযোগ নেই তাদের। টিভি কেনার সামর্থ্য নেই তাদের পরিবারের।

রাজধানী যাত্রবাড়ির বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইতি, চৈতি, দেবাশীষসহ আরও কয়েকজন জানান, ‘আমাগো বাপেরর অতো টাহা নেই যে টিভি কিইন্না দিবে। টেলিভিশন ক্লাস ধনীদের, আমাগো না’।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, টেলিভিশনে পাঠদানের উদ্যোগ নেয়ার আগে শিক্ষার্থীদের সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। তা না হলে দারিদ্র্যসীমার নিচের শিক্ষার্থীরা এ ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। সবার জন্য শিক্ষা- এ স্লোগান নিশ্চিত করার দাবি এ শিক্ষকের। 

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কাজী ফারুক বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় রাখতে শিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশনে পাঠদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে নিম্নবিত্ত কিংবা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শিক্ষার্থীরা এটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে টেলিভিশনে শিক্ষার সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।