স্থায়ী সনদ ছাড়াই চলছে ৪৮ বিশ্ববিদ্যালয়, নির্বিকার ইউজিসি

স্থায়ী সনদ না নেয়ায় অবৈধ হয়ে পড়েছে দেশের প্রায় অর্ধশত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এ তালিকায় রয়েছে নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, ইন্ডিপেডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশসহ (আইইউবি) শীর্ষস্থানীয় অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যদিও আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মধ্যে সব শর্ত পূরণ করে স্থায়ী সনদ নিতে বাধ্য সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠার শুরুতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাত বছরের জন্য সাময়িক অনুমতিপত্র দেয় সরকার। এ সময়ের মধ্যে আইনে বর্ণিত কয়েকটি শর্ত পূরণ করে স্থায়ী সনদের জন্য আবেদন করার কথা। শর্ত পূরণে সক্ষম না হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সাময়িক সনদ নবায়নের আবেদন করতে হবে। তদন্ত সাপেক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাময়িক অনুমতির মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত বাড়াতে পারবে। সবমিলিয়ে প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মধ্যে সব শর্ত পূরণ করে স্থায়ী সনদ নিতে বাধ্য সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এ মেয়াদের মধ্যে সনদপত্রের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে আইনে।

সাময়িক অনুমতিপত্র ও নবায়নের মেয়াদ মিলে ১২ বছর পার করেছে— দেশে এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫১টি। এরমধ্যে স্থায়ী সনদ পেয়েছে মাত্র ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া বাকি ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ই আইনত অবৈধ হয়ে পড়েছে। তবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ, তারা শর্ত পূরণ করেও স্থায়ী সনদ পাচ্ছে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ী সনদ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো— আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলোজি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটি। এর মধ্যে সিটি ইউনিভার্সিটিকে স্থায়ী সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টদের মতে, শর্ত সাপেক্ষে স্থায়ী সনদ দেয়ার সুযোগ নাই।

শর্ত পূরণ করে আবেদন করার সময় পার হলেও এখনো স্থায়ী সনদ পায়নি এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো— ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি চিটাগাং, ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলোজি, ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সটি চিটাগাং, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ, ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দ্য ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকগণ বিশ্ববিদ্যালয়, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি, ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলোজি, দ্য মিলোনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলোজি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলোজি অ্যান্ড সায়েন্সেস, প্রাইমেশিয়া ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি ঢাকা, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি, ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইসলামী ইউনিভার্সিটি এবং ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও ইস্ট ডেল্ট ইউনিভার্সিটি। এরমধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী সনদের জন্য আবেদন করেছে, যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর বিভিন্ন ধারায় এসব বিশ্ববিদ্যালয় অবৈধ হওয়ার প্রমাণ মেলে। মূলত ধারা ৬-এ বর্ণিত ১০টি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সাময়িক অনুমতি দিয়ে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে, অনধিক ২১ ও অন্যূন ৯ সদস্যের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন, পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি, সেমিনার কক্ষ, অফিস কক্ষ ও শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক কমন রুম সহ পর্যাপ্ত স্থান অবকাঠামো থাকা, ২৫ হাজার বর্গফুটের নিজস্ব বা ভাড়া বাড়ি, কমপক্ষে ৩টি অনুষদ ও ৬টি বিভাগ থাকা, শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কিত একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রত্যেক বিভাগ, প্রোগ্রাম ও কোর্স এর জন্য কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক পূর্ণকালীন যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা, নিবিড় পাঠ্যক্রম ও কোর্স প্রণয়ন ও আসন সংখ্যার অনুমোদন, সংরক্ষিত তহবিল হিসেবে এলাকাভেদে দেড় থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা রাখা এবং কোনো ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী ও জঙ্গী কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা না করা।

এসব শর্ত পূরণের ভিত্তিতে দেয়া সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ সাত বছর। এ সময়ের মধ্যে আরো সাতটি পূরণ করে স্থায়ী সনদের জন্য আবেদন করার কথা আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। শর্তগুলো বর্ণনা করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৯ ধারায়। এর মধ্যে রয়েছে, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১ একর অন্য এলাকার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই একর নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত জমি থাকা, নিজস্ব জমিতে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ, ৩ শতাংশ আসন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও ৩ শতাংশ আসন অনুন্নত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা এবং গবেষণার জন্য বাজেট রাখা ও ব্যয় করা।

আইন বলছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সনদপত্রের শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ১২ ধারার ১ উপধারায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে, কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদের মধ্যে বা, ক্ষেত্রমত, নবায়নকৃত অনুমতিপত্রের মেয়াদের মধ্যে সনদপত্রের জন্য আবেদন করিতে ব্যর্থ হইলে, অথবা সনদপ্রাপ্তির জন্য ধারা ৯ এর কোন শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে উক্ত সাময়িক অনুমতিপত্র বা, ক্ষেত্রমত, নবায়নকৃত সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ করিতে হইবে।

তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, সাময়িক সনদের মেয়াদ নবায়ন না করে থাকলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ অবৈধ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে ইউজিসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পালন করার কোনো এখতিয়ার নাই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ভর্তিসহ সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণ অবৈধ। এখন আইন প্রয়োগের দায়িত্ব হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তারা ব্যবস্থা না নিলে ইউজিসির কি করার থাকে।’

সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আইনে শর্ত পূরণ না করলে বন্ধ করে দেয়ার কথা থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে আমরা কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ভাবছে তারা ১৯৯২ সালের আইনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী স্থায়ী সনদের জন্য আবেদন করবে না, তারা একটি ভুল ধারণার মধ্যে রয়েছে। তাদের অবশ্যই আইন মেনে আবেদন করতে হবে।’