হয়তো বিচার না পাওয়াই আজ আইনের শিক্ষক বানিয়েছে

অর্থনৈতিক

ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর ইউনিয়নের সাতুরিয়া গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম মো. লিমন হোসেনের। বাবা পেশায় কৃষক আর মা গৃহিণী। সাতুরিয়া ১নং প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের শুরু। এরপরে পিজিএস কাউখালী কারিগরি বহুমুখী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ২০১৭ সালে সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে অনার্স আর ২০১৯ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।

লিমন জীবন সংগ্রামের অপর নাম। প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক দুরবস্থার সাথে লড়াই করে জীবন ধারণ করা লিমনের জীবনে হঠাৎ করে নতুনভাবে যুক্ত হয় আরো একটা কঠিন সংগ্রাম। এবার শুরু হয় রাষ্ট্রীয় শক্তি মোকাবেলা করার সংগ্রাম, জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম, অস্ত্বিত বজায় রাখার সংগ্রাম। এই যেন মরার উপর খড়ার ঘাঁ। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ পড়ন্ত বিকেলে মাঠে গরু আনতে গিয়ে র‌্যাবের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নতুন সংগ্রামী জীবনের সূচনা ঘটে। র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটিলিয়ন-৮ এর একটি দল একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরতে গিয়ে লিমনকে একটি ব্রিজের উপর একা বসে থাকতে দেখে সন্দেহ করে। সন্দেহ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ। তারপর সন্ত্রাসী সাজানোর অপচেষ্টা।

এরপরে লিমনকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে পায়ে গুলি করে ফেলে রেখে যায় র‌্যাব সদস্যরা। ঘটনার ২ দিন পরে লিমনকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে ডান পা হারাতে হয়েছে। পা হারানো লিমনের নামে ঠুকে দেওয়া হলো দুটি মামলা। এবার লড়াইটা আরো বড় হয়ে গেলো। মামলায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার অন্যসব সংগ্রামের সাথে মামলায় জয়েও সংগ্রাম করতে হয়। একটা সময় মামলা থেকেও অব্যাহতি মেলে। পা হারানো লিমনকে, রাষ্ট্রীয় হয়রানির কঠিন বাস্তবতাকে ধারণ করে পড়াশোনারও চাপ সামলাতে হয়েছে। সবকিছু চাপিয়ে র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন এখন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষক। জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে ছাপিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের একজন যুবকের শিক্ষক হয়ে উঠার গল্প সাক্ষাৎকারে তুলে নিয়েছেন তানভীর আহম্মেদ এবং অনিক আহমেদ

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
মো. লিমন হোসেন: যেহেতু অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের একজন সন্তান ছিলাম, স্বপ্নটাও ছিল ওই কেন্দ্রিক। অনেক বড় একজন মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। এমন বড় মানুষ হতে চেয়েছিলাম, যে মানুষের কোন অভাব থাকবে না। পরিবারের মানুষগুলোকে সুখে রাখতে পারবো, নিজেও সুখে থাকবো। একটি সুখী জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখতাম।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: চরম অনিশ্চয়তার মাঝে স্বপ্নের বাস্তবায়ন কিভাবে ঘটাবেন তা নিয়ে কি ভাবতেন?
মো. লিমন হোসেন: অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। তবুও মনের ভিতর একটা শক্তি কাজ করতো। আমার এখান থেকে বের হতে হবে, উঠে দাঁড়াতে হবে। বাবা-মায়ের কথা ভাবতাম, তাঁদের নিয়ে চিন্তা করতাম। এসবের সাথে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক, দেশবাসী, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ সবাই আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিল, অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, সাহস দিয়েছিল। সকল ধরনের মানুষ আর সংগঠনের এসব উপাদানই আমাকে বাঁচার নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সবার সাহয্য-সহযোগিতা এবং দোয়া আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এই আত্মবিশ্বাস সাথে নিয়েই নিজেকে স্বপ্নের দোয়ারে দাঁড় করেছি বারবার।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: র‌্যাবের গুলি খাওয়ার পরে মামলায় ফেঁসে যাওয়া বিষয়টা কিভাবে দেখছেন?
মো. লিমন হোসেন: র‌্যাব এসে যখন আমার কলার ধরে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা চালায়, তখনই বলেছিলাম আমি একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান, এখানে গরু চরাতে এসেছি। আমি একজন ছাত্র, আমি নির্দোষ স্যার। আমাকে ছেড়ে দিন।

তবুও অন্যায়ভাবে গুলি করা হয়েছিল। গুলি করা শেষে তাদের অন্যায় ঢাকার জন্য, তাদের অপকর্ম ঢাকার জন্য মামলা দিয়ে আমাকে মিথ্যে হয়রানি করেছে। আমার উপর চরম অন্যায় করা হয়েছিল। আমি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চরম জঘন্যতার শিকার। শুধু একটা কথাই সবসময় ভাবতাম, সত্যের কখনো পরাজয় হয় না, সত্য একদিন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নামে জড়িয়ে যাওয়া মিথ্যা কলঙ্কটাকে ছুড়ে ফেলবেই। সত্যি আজ তাই হয়েছে সত্যটা আমার জন্য সত্যি হয়ে ফুটেছে। শুধু মাঝখানে আমার জীবনটাকে দুঃসাধ্য করে তুলেছিল। ওইসব কথা বলতে গেলে এখনো নিজেকে ধরে রাখতে পারি না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রাষ্ট্রীয়, দারিদ্র্য এবং মানসিক প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন কিভাবে?
মো. লিমন হোসেন: আমি গুলিবিদ্ধ পা নিয়ে অসুস্থ ছিলাম প্রায় সাত মাস। ওই সাত মাস অসুস্থ আবার প্রিজন সেলেও বন্দি থাকতে হয়েছে। এসবের জন্য আমার জীবন থেকে ১ বছর হারিয়ে যায়।এসময় পড়াশোনা করতে পারিনি এবং ভবিষ্যতে পড়াশোনা করতে পারবো কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ ছিল। কিন্তু মানুষজনের এতো ভালোবাসা আর সাহায্য পেয়েছিলাম যে আমাকে পড়াশোনায় ফিরে আসতে বেগ পেতে হয়নি। দেশের সর্বস্তরের মানুষ আমাকে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। বিশেষ করে প্রথম আলো এবং গণস্বাস্থ্যের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। এই দুইটা প্রতিষ্ঠানের অবদান সবচেয়ে বেশি। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং সবার সাপোর্ট আমাকে সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অনেক বিষয় থাকতে আইন বিষয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে জাগলো কেন?
মো. লিমন হোসেন: আমার মাকে দেখেছি শুধু একটু ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে মানুষের দোরায়ে দোয়ারে ঘুরে বেড়িয়েছিল। বিষয়টা আমাকে বিমর্ষ করে দিয়েছিল। আমিও আইনের সুশাসনের অভাবে বড় ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হয়েছি। এসব ঘটনা আমাকে আইন পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ভাবিয়ে তুলছিল একজন সঠিক আইনের মানুষ হয়ে মানুষকে সাহায্য করতে, ন্যায় বিচার করে পাশে থাকার জন্য। এসব কিছু থেকে মূলত আইনে পড়ার ইচ্ছে হয়। এবং এই বিষয়ে পড়াশোনা করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয় আইনে ভর্তি হওয়ার অনুভূতি কেমন ছিল?
মো. লিমন হোসেন: আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না কতটা খুশি হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু কোথাও সুযোগ হলো না। শেষে ডা. জাফরুল্লাহ আমাকে এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেন। আমি এই মানুষটাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করতে পারবো না। এখানে ভর্তি হতে পেরে অসম্ভব খুঁশি হয়েছি আমি। এক কথায় অসাধারণ অনুভূতি ছিল আমার।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অনেক প্রতিকূলতা হারিয়ে আপনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এই বিষয়টা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মো. লিমন হোসেন: আমি যে শিক্ষক হবো সেটা কখনো কল্পনাও করতে পারি নাই। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরকে কিভাবে ধন্যবাদ দিব তা আমার জানা নাই। শিক্ষক হওয়ার পিছনে উনার অবদান সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রমুখ উঁচুমানের ব্যক্তিরা পথ দেখিয়েছিলেন। আমি মনে করি, শিক্ষক হওয়ার জন্য যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়। হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও আমি সেভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছি। এই গড়ে তুলাটাই আমাকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে সাহায্য করেছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন এখন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এই অনুভূতিটা কেমন?
মো. লিমন হোসেন: এই প্রশ্নটা আমার মাকে জিজ্ঞেস করলে বোধ হয় বেশি ভালো হতো। কারণ মায়ের অনুভূতিটা আমার থেকে হাজার গুণে বেশি। গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত মহিলা। এসব বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষদের গর্বের সাথে যেভাবে বলে বেড়ায় আমার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হইছে। তখন চোখে পানি এসে যায়। মায়ের এই গর্বের অনুভূতিটাই আমার হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়। আমার সুখ এখানেই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষক হিসবে কেমন সহায়তা পাচ্ছন, সবাই কীভাবে গ্রহণ করছে?
মো. লিমন হোসেন: ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে যোগদান করি। অল্প দিনেই সবাই খুব আপন করে নিয়েছে। সবাই আমার বিষয়টা জানে। সবাই খুবই সাহায্য করে। এদিক থেকে বলতে পারি সবাই বেশ ভালো ভাবেই আমাকে গ্রহণ করেছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. লিমন হোসেন: আফাতত শিক্ষক হিসবে নিজেকে ধরে রাখতে চাই, সামনে জুড়িশিয়াল পরীক্ষার ফলাফল আসবে সেটা দেখার পরে নতুন করে ভাববো। তবে আমি যাই হই না কেন আইনের সুশানের জন্য আমি লড়াই করে যাবে।আমার মতো আর একটা লিমন যেন তৈরি না হয় তাঁর জন্য লড়াই করবো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অদম্য লড়াই করে যারা এগিয়ে যাচ্ছে এবং যারা এগিয়ে যেতে চাই তাদের সম্পর্কে কি বলার আছে?
মো. লিমন হোসেন: তাঁদের বলবো যতো কঠিন বাধাই আসুক না কেন থেমে যেও না, থেমে গেলে চলবে না। পড়াশোনা করতে হবে, পড়াশোনার বিকল্প কিছু নাই। সবসময় বুকে সাহস রাখতে হবে। কখনো অপশক্তি দেখে ভয় পেলে চলবে না। সব সময় আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে, আত্মবিশ্বাস এগিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করে।