১২ বছর বিদেশে থেকে এখন নিজ দেশকে অস্বীকার!

আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম

বাংলাদেশ থেকে ফেরার সময় কাতারের দোহা শহরে এক রাত থেকে এসছি। দোহাতে ইমিগ্রেশন পার হবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর আমার এক বাংলাদেশি ছাত্র। পাশের লাইনেই দেখি এক বাংলাদেশি ছেলে আর দুই মেয়ে। এরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলছে। ছেলেটার বয়েস ২৭-২৮ হবে হয়ত। আমার ছাত্র পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেছে।

আপনি বুঝি ফিনল্যান্ডে থাকেন?
-হ্যাঁ।

আমি বুঝতে পারলাম আমার এই ছাত্রের ওই ছেলের সাথে কথা বলার বেশ আগ্রহ আছে। এর অবশ্য একটা কারণও আছে। ওর বোন ফিনল্যান্ডেই থাকে। তো এরপর আমার ছাত্র ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেছে।

—ঢাকাতে আপনার বাসা কি মিরপুরে?

ছেলেটা এরপর যে উত্তর দিয়েছে; শুনে আমার চোখ কপালে উঠার জোগাড়! অর্ধেক ইংলিশ এবং অর্ধেক বাংলাতে ছেলেটা যেই উত্তর দিয়েছে সেটাই বরং লেখা যাক।

—আমি আসলে মোর অফ এ ফিনিশ দ্যেন এ বাংলাদেশি। আমি প্রায় ১৪ বছর ফিনল্যান্ডে থাকি।

শুনে আমি রীতিমত অবাক হয়েছি! পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আমার ছাত্রও অবাক হয়েছে! কারণ সে এরপর আর ওই ছেলের সঙ্গে একটা কথাও বলেনি! অর্থাৎ এই ছেলেটা বলতে চাইছে সে আসলে বেশিরভাগ অর্থেই ফিনিশ; বাংলাদেশি না!

যেই ছেলের জন্ম বাংলাদেশে। যার বাপ-মা চৌদ্দ গোষ্ঠী থাকে বাংলাদেশে। যার স্কুল-কলেজের পড়াশুনা বাংলাদেশে। সে ১২ বছর ফিনল্যান্ডে থেকে এখন নিজ দেশকে অস্বীকার করছে! শুধু তাই না, কাতারের মত একটা দেশে নিজ দেশের মানুষের কাছে সে পরিচয় দিচ্ছে সে আসলে ফিনিশ! বাংলাদেশি না! অর্থাৎ বাংলাদেশি পরিচয় দিতে তার লজ্জা হচ্ছে কিংবা সঙ্কোচ হচ্ছে!

নিশ্চিত জেনে রাখুন যেই দেশের নাগরিক বলে সে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে, সেই দেশের মানুষজন হয়ত তাকে স্রেফ একজন ইমিগ্রেণ্ট হিসেবেই ভাবে। আর এই ছেলের কিনা সে কি ভাব! সে এক জন ফিনল্যান্ডের নাগরিক! বিদেশে থাকা বেশিরভাগ বাংলাদেশিদেরই আসলে এমন অবস্থা! এরা নিজ দেশের পরিচয় দিতে পর্যন্ত লজ্জা পায়! আত্মপরিচয় ভুলে থাকা এই জাতি আবার মহা আনন্দে মেতে উঠে, যখন শুনে বাংলাদেশের সাথে একটু সম্পর্ক আছে এমন কিছুতে গর্ব করা যায়!

কোন এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাকি ইন্টেল বা এই রকম এক কোম্পানির চিফ বা এই টাইপ একটা পজিশন পেয়েছে। এই নিয়ে এখন দেখছি বাংলাদেশি পত্র-পত্রিকা আর ফেসবুকে নানান সব লেখা! সবাই লিখছে- বাংলাদেশি হিসেবে গর্বিত ইত্যাদি ইত্যাদি!

অথচ এই ভদ্রলোকের জন্ম আমেরিকায়, পড়াশুনা আমেরিকায়, বেড়ে উঠেছে আমেরিকায়! বাংলাদেশের সাথে তার সেই অর্থে কোন যোগাযোগ'ই নেই! তাতে কি হয়েছে! লতায়-পাতায় হলেও তো কোন না কোন ভাবে তার বাংলাদেশি পরিচয় বের করা গিয়েছে! এরবার একটু গর্ব করে নেয়া যাক!

যেই জাতি নিজ দেশের পরিচয় পর্যন্ত দিতে লজ্জা পায় বিদেশে এসে; সেই জাতি আবার এইসব নিয়ে গর্ব করছে! পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম গতকাল এক দিনে পাঁচ বাংলাদেশিকে মেরে ফেলেছে ভারতে'র সীমান্ত বাহিনী বিএসএফ! এই নিয়ে অবশ্য আমাদের কারো কিছু যায় আসছে না! এ আর এমন কি! আমারা বাংলাদেশি। আমরা বেঘোরে ভারতের সীমান্ত বাহিনীর হাতে মারা যাবো; এটা'ই তো স্বাভাবিক !

অথচ চারদিকে ভারতের সীমান্ত থাকা নেপালের মত অতি ক্ষুদ্র দেশে স্রেফ একজন মানুষ'কে ভারতের বিএসএফ হত্যা করেছিল। এর জন্য পুরো নেপাল জুড়ে আন্দোলন হয়েছে। শেষমেশ ভারত সরকার ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে। আর আমরা বাংলাদেশি'রা বছরের পর বছর বেঘোরে মারা যাচ্ছি ওদের হাতে। এতে অবশ্য কিছু'ই হচ্ছে না। হবে কি করে?

আমরা তো সেই জাতি, যারা নিজদের বাংলাদেশি পরিচয় দিতে'ই লজ্জা পাই! আমরা তো সেই জাতি, যার প্রায় ৮০ ভাগ তরুণ প্রজন্ম এখন বিদেশে যেতে চায়! আমরা তো সেই জাতি, যারা মনে করে বিদেশে থাকাই একটা স্ট্যাটাস!

আমরা তো সেই জাতি, যার ২৭-২৮ বছরের এক যুবক কাতারের মত একটা বিদেশি জায়গায় স্বদেশী আরেক ভাই'কে বুক উঁচিয়ে বলছে- আমি আসলে এখন বেশির ভাগ অর্থে ফিনিশ; সেই অর্থে বাংলাদেশি নই!

এটা বলছে এক বিষয়। বলে যে সে কি মজা'টা নিয়েছে, সেটা ছিল দেখার মত! সে এমন একটা ভাব করল- সে বিশাল কিছু! অথচ এরা'ই আবার হয়ে যায় বিরাট দেশ প্রেমিক!

এই জাতি অন্য দেশের সীমান্ত বাহিনীর গুলিতে মারা যাবে, কাঁটাতারে ঝুলে থাকবে এটা'ই স্বাভাবিক।যেই জাতি আত্মপরিচয় অস্বীকার করে মজা পায়; আনন্দ পায়, গর্ব করে; সেই জাতি'র ভাগ্য এমন হবে এটা'ই স্বাভাবিক। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)