কথিত প্রগতিশীলদের ওড়না এলার্জি

ধর্মীয় পোষাকে নারী-প্রতিকী

দেশে নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের।শুধু কী নারী? পুরুষদের পোশাক নিয়েও হয়েছে নানান বিতর্ক।আমরা বাঙালি ইমোশনাল জাতি। আজ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় পোশাক নির্ধারণ করতে পারিনি। যদিও কেউ কেউ পাজামা, পাঞ্জাবি ও শাড়িকে জাতীয় পোশাক হিসেবে পরিচয় করাতে অভ্যস্ত। কিছুদিন আগে একজন ব্যক্তি বাঙালির জাতিগতভাবে প্রিয় পাঁচটি বস্ত্র— শাড়ি লুঙ্গি গামছা ব্লাউজ ও পাঞ্জাবিকে জাতীয় পোশাক ঘোষণার দাবি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন।

বাংলাদেশের সিংহভাগ নারী ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে মিল রেখেই পোশাক পরিধান করে থাকেন।ইদানিং ভারতীয় টিভি চ্যানেল ও মিডিয়ার বদৌলতে এদেশে নারীর পোশাক আশাকে পড়েছে ভারতীয় প্রভাব। প্রায় আমাদের জাতীয় অঙ্গনে পোশাক বিতর্ক দেখা দেয়।

রাজধানীর নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও বনশ্রী আইডিয়ালে মেয়েদের ওড়না পরা নিষিদ্ধ করেছে গভর্নিং বডি। এমন একটি সংবাদ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক আশাক নিয়ে এরকম বিতর্ক বিভিন্ন সময় দেখা গেছে। ছেলেদের পোশাক পরা নিয়ে কিছুদিন আগে কুয়েটের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা র‌্যাগ ডে উপলক্ষ্যে জুব্বা এবং মাথায় পাগড়ি পরিধান করে। এই পোশাক পরে তারা মিছিল করে পরবর্তীতে শহীদ মিনার চত্বরে ফটোসেশন করে। এটি অতি সাধারণ ঘটনা। র‌্যাগ ডে উপলক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যাচ বিভিন্ন পোশাক পরিধান করে উদযাপন করে। এমনকি বিভিন্ন দেশের ট্রেডিশনাল পোশাক পরেও আনন্দ করে।

তা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। সেবিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছি না।তবে বলতে চাই থার্টি ফাস্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন ডের নামে পরকীয় সংস্কৃতি উদযাপনে যেখানে বাধা নেই। সেখানে মাথায় পাগড়ি, জুববা পরে একদিন আমোদ ফুর্তি করা, কারো কারো কাছে চুলকানি খাউজানির মতো মনে হয়েছে। যত চুলকায় ততই স্বর্গীয় পুলক অনুভব করে।আমাদের পার্শবর্তী ভারতের চ্যানেলের অবাধ প্রদর্শনে আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতি যেখানে বিলুপ্ত প্রায় সেখানে কথিত সুশীলদের নীরবতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।

আসলে তাদের মোটিভ কী? তারা কি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অথবা দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় অনুপ্রাণিত করে?বা দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় উৎকণ্ঠিত? না কোনো দেশের এজেন্ট হয়ে তাদের সুরে কথা বলেন? কুয়েটের ছেলেরা একদিনের জন্য পাগড়ি, জুববা পরেছে স্বেচ্ছায়। কিন্তু রাজধানীর দুটো স্কুলে ড্রেস কোডের নামে যা বলা হয়েছে তা আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।

শুধু তাই নয় সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সুষ্পষ্ট লংঘন। ড্রেস কোডের নামে কেউ কারো পরিধেয় পোশাক নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দীর্ঘদিন থেকে দেশের প্রচলিত ড্রেস কোডের বাইরে ছিল। কলেজের ড্রেস কোডে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার একটা ঐতিহ্য ছিল। শিক্ষার্থীদের ড্রেসে ইসলামি মূল্যবোধ মেনে চলা হতো।সেখানে ছেলেদের জন্য টুপি, মেয়েদের জন্য স্কার্ফ ও অতিরিক্ত হিসেবে বড় ওড়না বাধ্যতামূলক ছিল।

এখন থেকে ছেলেদের টুপি পড়তে হবে না। মেয়েদের বড় ওড়না ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিবর্তিত মূল ড্রেস কোডে রয়েছে সালোয়ার, কামিজ, ক্রস বেল্ট ওড়না ও জুতা। এর আগে মেয়েদের ড্রেস কোডে ফ্রগ নির্ধারিত ছিলো, এখন কামিজ নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকে এগুলোকে ঐচ্ছিক করা হয়েছে মাধ্যমিক শাখার জন্য।বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ড্রেস কোডের নামে ছাত্রীদের হেনস্তা করা হয়। তবে এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা হিসেবে কলেজের অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, স্কুল ড্রেসের সঙ্গে অনেক মেয়েরা বাড়তি ওড়না পরলেও তা গলায় ঝুঁলিয়ে রাখে, ঠিকভাবে তা পরছে না। অনেকের এই ওড়না ময়লা হয়ে গেলেও তা পরিষ্কার না করেও ব্যবহার করছে। ময়লা ওড়নার কারণে তাকে দেখতে খারাপ দেখায়। এটি নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেছেন। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তার যুক্তি গুলো অযৌক্তিক ও হাস্যকর।

যদিও ওড়না ইসলামী সভ্যতার কোনো পোশাক নয়।ইসলামে নারীদের যে পর্দা বিধান ফরজ করেছে। ওড়না খানিকটা তার শূন্যস্থান পূরণ করে। যা কিছু শালীন ও মানুষকে পরিশীলিত করে তা গ্রহণে ইসলামে বিধি নিষেধ নেই। ইসলামে হিজাব ও যিলবাবের কথা বলে হয়েছে।আরবি শব্দ হিজাব একটি নেকাব যা মাথা এবং বুক আবৃত করে থাকে। আল্লাহ পাক বলেন, হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না।

আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব : ৫৯)।মুসলিম প্রধান দেশে ওড়নার ন্যায় নারীর ইজ্জত ও আব্রুর নিরাপত্তার রক্ষাকবচ অস্বীকার করা মানে নারী জাতিকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপনের নীলনকশা। নারী সৌন্দর্য ও সতীত্ব নির্ভর করে তার শালীনতা ও পোশাকের ওপর। তা যদি এভাবে স্বল্প বসনে নামিয়ে আনা হয় তা হবে জাতি হিসেবে চরম অবক্ষয়ের পরিচায়ক ও অশ্লীলতার পথ কুসুমাস্তীর্ণ করার নামান্তর।

ওড়না কি? এর নতুন করে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। তারপরও প্রাথমিক পরিচয়ে বলা যায়, ওড়না মেয়েদের একটি পোষাক, এটি চাদর বা দোপাট্টা নামেও পরিচিত। এটি একপ্রস্থ একটি কাপড় যা সাধারণত বুকের ওপর পরিধান করা হয়, তবে অনেকে ওড়না মাথা আবৃত করতেও ব্যবহার করেন। খিমার শব্দের অর্থ হলো ওড়না, দোপাট্টা বা ওড়নি। যা সাধারণত সালোয়ার কামিজের সাথে পরা হয়। এবং সেটা একটি মাত্র খিমার দিয়েই। এই ধরনের ওড়না পড়াকেও হিজাব বলা হয়।

ওড়নার ব্যবহার মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে দেখা যায় ।যতটুকু জানা পায় ওড়নার উৎপত্তি প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায়। এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিন্ধু নদের অববাহিকায়।সিন্ধু সভ্যতা একটি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা ছিল (৩৩০০ – ১৩০০) খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। সেসময় এ ধরনের বস্ত্র নামের ওড়নার ব্যবহার প্রচলিত ছিল। হরপ্পার এক পুরোহিত রাজার মূর্তির বাম কাঁধ চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল যা প্রমাণ করে যে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই ওড়নার প্রচলন ছিল।

গত বছর প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যবইতে বাংলা ভাষার বর্ণ পরিচয় তুলে ধরতে ওড়না কে পরিচয় করে দেওয়া হয়। সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পাঠ্যপুস্তকে প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইতে 'ও' বর্ণটি দিয়ে ‘ওড়না’ পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। শিক্ষাবিদরা সেইসময় 'ও'তে ‘ওড়না’ শব্দটি ব্যবহার না করে ভিন্ন কোন শব্দ ব্যবহার করলেই ভালো হতো বলে অভিমত জানান।শেষতক কর্তৃপক্ষ তা সংশোধন করতে বাধ্য হয়। কবি হেলাল হাফিজ যেখানে নারীর আব্রুর প্রতীক ওড়নাকে নিয়ে বললেন, 'তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।' কবির এ কবিতার শ্লোক নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি।প্রেমিকার/ নারীর প্রতি অস্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে কবি এমনটি বলেছেন।

ওড়না তুলে দেওয়ায় অভিভাবকদের মাঝে এর একটি প্রভাব পড়েছে , সেটি হচ্ছে একজন ছেলে টুপি না পরে স্কুলে গেলে খুব একটা সমস্যা নেই, কিন্তু কোন বাবা-মা চাইবে তাদের মেয়েকে ওড়না ছাড়া স্কুলে পাঠাতে? একটা মুসলিম প্রধান দেশে এমন সিদ্ধান্ত কিভাবে হতে পারে তা চিন্তাশীল মানুষের বোধগম্য নয়। কেউ কেউ আবার প্রশ্ন করছেন, একজন ছাত্রীর কী সম্ভব ওড়না ছাড়া পুরুষ শিক্ষকের সামনে যাবে? সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রক্ষায় এমন সিদ্ধান্ত পরিহার করা প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্ত তথাকথিত নারীবাদী নামের ভোগবাদীদের ইশারায় যে করা হয়েছে তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই।ইরানি একটি প্রবাদ রয়েছে, নগ্নতা যদি সভ্যতা হয় তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জীবজন্তু।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক