দিলীপ কুমার হতে এ আর রহমান, পেটের দায়ে গান শিখেছিলেন যিনি

২০০৪ সালে ‘টাইমস ম্যাগাজিন’ তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। আর ২০০৯ সালে লন্ডনের ওয়ার্ল্ড মিউজিক ম্যাগাজিন তাঁকে ‘ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মিউজিক আইকন’দের মধ্যে একজন বলে অভিহিত করে। সম্প্রতি ব্রিটেনভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘টুমরোস মিউজিক আইকন’ উপাধি দিয়েছে।গল্পটা সুরের জাদুকর এ আর রহমানের। আজ তার জন্মদিন ৫৩তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন এ আর রহমান।

মিউজিকে লিজেন্ড তিনি। যার সুরে মুগ্ধতা পায় কোটি প্রাণ, ছুঁয়ে যায় হৃদয়, মন। তামিল থেকে শুরু করে হিন্দি গান সর্বত্রই তার অবাধ বিচরণ। পাঞ্জাবি, সুফি, পপ থেকে শুরু করে তার কম্পোজিশনে মিলেছে বাংলা বাউল সুরের ছোঁয়াও। ভারতীয় সঙ্গীতের দুনিয়ায় তিনি এক অপার বিষ্ময়। তাঁর কাজগুলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে ইলেক্ট্রনিক মিউজিক এবং ওয়ার্ল্ড মিউজিক এবং পশ্চিমা অর্কেস্ট্রাল মিউজিকের সম্মিলনের জন্যে বিখ্যাত। তাঁর পাওয়া পুরস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে দুটি oscar, একটি ‘বাফটা পুরস্কার’, একটি গোল্ডেন গ্লোব, চারটি ন্যাশনাল ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড এবং ১৩ টি ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড। এছাড়া কাজের জন্যে তাঁকে ‘মাদ্রাজের মোজার্ট’ বলা হয় এবং তামিল ভক্তরা তাঁকে ‘মিউজিকের ঝড়’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন।

২৩ বছর বয়সে তিনি ইসলামের সান্নিধ্য পান এবং পুরো পরিবারকে নিয়ে ইসলামের ছায়াতলে স্থান গ্রহন করেন। এক সাক্ষাৎকারে ইসলাম গ্রহণ করা নিয়ে রহমান বলেছিলেন, ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম এর গুরুত্ব, সিস্টেম, ভ্যালু। এগুলো আমার আগের বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিল, তখন আমি নিজে থেকে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করে এ আর রহমান নাম গ্রহণ করি।

টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ইসলাম গ্রহন করতে তার ১০ বছর সময় লেগেছে। তার মা একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। তাই হঠাৎ করে ইসলাম গ্রহণ করাটা এতটা সহজ ছিল না।

একটি সূত্রের তথ্য, ১৯৮৪ সালে রহমানের ছোট বোন প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসক এবং কবিরাজ দেখানোর পরও তিনি সুস্থ হচ্ছিলেন না। এই পরিস্থিতিতে তার মা আজমীর শরীফে মানত করেন। ১৯৮৮ সালে আল্লাহর রহমতে একজন মুসলিম পীরের সাহায্যে তার অসুস্থ বোন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে উঠলে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আসে এবং সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ সময় তার নাম রাখা হয় আল্লাহ রাখা রহমান বা সংক্ষেপে এ আর রহমান। এ আর রহমানের স্ত্রী সাইরা বানু, তাদের তিনটি খাদিজা, রহিমা এবং আমিন নামে তিনটি সন্তান রয়েছে। এ আর রহমান তামিল, তেলেগু, হিন্দি সহ হলিউডেও নিজের স্বকীয় কাজের ছাপ রেখেছেন। শুধু মাত্র ট্র্যাডিশনাল সঙ্গীত নয়। ইসলামী সঙ্গীতে তিনি অবদান রেখেছেন।

নিজের ব্যক্তি জীবনকে খুব একটা প্রচারে আনেন না তিনি। একাকীই জীবন-যাপন করেন। 

 

১৯৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি বর্তমান এ আর রহমান জন্মেছিলেন। তার বাবা আর কে শেখর মুধালিয়ার ছিলেন মালায়ালাম মুভির একজন মিউজিক কম্পোজার ও কন্ডাক্টর। তার মায়ের নাম ছিল কস্তুরি (মুসলিম হওয়ার পরে তার নাম হয় করিমা বেগম)।

বাবা সংগীত পরিচালক হলেও বাবার কাছ থেকে সংগীত শিক্ষা নেওয়ার খুব বেশি সুযোগ পাননি। কারণ, ১৯৭৬ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। পিতার চিকিৎসার জন্য টাকার অভাব, তার যন্ত্রণা, পরিচিত মানুষের তীব্র উদাসীনতা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের উপেক্ষা দিলীপকে খুব কষ্ট দেয়। আরও কষ্ট দেয়, বিশেষত তাঁর পিতার মৃত্যুর দিনটি। ওই দিনেই তার বাবার সুরারোপিত প্রথম চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেলেও তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

বাবা চলে যাওয়ার পর মাকে কেন্দ্র করেই বেড়ে উঠেছেন রহমান। বাবার দুটো কি-বোর্ড ভাড়া দিয়ে তখন সংসার চলত তাঁদের। ১১ বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন অর্কেস্ট্রা দলের সঙ্গে কি-বোর্ড বাজাতে শুরু করেন রহমান। সেটা অবশ্য নেহাতই পেটের দায়ে। ভারতীয় একটি সংগীত মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ আর রহমান বলেছিলেন, ১১ বছর বয়স থেকেই অনেকে আমাকে চিনত। আমার কাজ ছিল, ফরমায়েশি ফিল্মি গান কি-বোর্ডে বাজানো।’

তার মিউজিক করা উল্লেখ করার মতো হিন্দি মুভিগুলো হলো বোম্বে (১৯৯৫), রঙ্গিলা (১৯৯৫), দিল সে.. (১৯৯৮), তাল (১৯৯৯), লগান (২০০১), সাথিয়া (২০০২), রাঙ্গ দে বাসন্তী (২০০৬), গুরু (২০০৭), যোধা আকবর (২০০৮), জানে তু... ইয়া জানে না (২০০৮), স্লামডগ মিলিয়নেয়ার (২০০৮), ইয়ুভরাজ (২০০৮), গজনি (২০০৮), দিল্লি-৬ (২০০৯) ইত্যাদি। কম্পোজিশনের পাশাপাশি তিনি একজন অসাধারণ ভোকালিস্টও; হাইপিচ, স্পিরিচুয়ালিটি তার কণ্ঠের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

এ আর রহমানের কণ্ঠের প্রথম গান মুভি বোম্বের (১৯৯৫) হাম্মা হাম্মা। তবে বন্দে মাতরাম (বন্দে মাতরাম), লুকা ছুপি (রাঙ্গ দে বাসন্তী), তেরে বিনা (গুরু), খাজা মেরে খাজা (যোধা আকবর), ও... সয়া (স্লামডগ মিলিয়নেয়ার), রেহনা তু (দিল্লি-৬) ইত্যাদি ট্র্যাকগুলোকে তার ভোকাল মাস্টার পিস বলা যেতে পারে।

এ আর রহমান সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য

  • ১৯৯২ সালে মণিরত্নম পরিচালিত এক কফির বিজ্ঞাপনে জিঙ্গলস গেয়ে তাক লাগিয়ে দেন। আর এরপরই তিনি মণিরত্নমের তামিল ফিল্ম ‘রোজা’য় প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজের সুযোগ পান। পারিশ্রমিক হিসেবে পান ২৫হাজার টাকা।
  • শিশু শিল্পী হিসেবে দুরদর্শন- ‘ওয়ান্ডার বেলুন’ শোতে দেখা গিয়েছিল রহমানকে। যিনি একসঙ্গে ৪টি কী বোর্ড বাজিয়ে জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
  • সুরকার নয়, রহমান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন।এ আর রহমান ও তার ছেলে আমিন এর (৬ জানুয়ারি) একই দিনে জন্মদিন। রহমানের অস্কার জয়ী ‘জয় হো’ গানটি আদপে সালমান খানের ‘যুবরাজ’ ফিল্মের জন্য তৈরি হয়েছিল।
  • ২০১৪ সালে তিনি ৪টি জাতীয় পুরস্কার, ১৫টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছিলেন। সেবছর ১৩৮টি নমিনেশনের মধ্যে ১১৭টিতেই পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন রহমান।
  • গোটা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে তিনিই প্রথম একই বছর দু'টি অস্কার জিতেছিলেন।
  • এ আর রহমানের নামে কানাডার মরখমে একটি রাস্তাও রয়েছে।