সুচি একজন মিথ্যুক, মুসলিম বিদ্বেষী নোবেল জয়ী

সুচি ও মো. আবু রায়হান

১৯৯১ সালে গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে সংগ্রামের জন্য মায়ানমারের গণতন্ত্রীপন্থী নেত্রী সুচিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন তিনি। যদিও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তার নেতিবাচক ভূমিকার কারণে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে তিনি তীব্রভাবে সমালোচিত। শান্তিতে নোবেল জয়ীদের ইতিহাসে সুচি বোধহয় সবচেয়ে অযোগ্য, সত্য বিমুখ, বাস্তবতা বিবর্জিত ও ধর্ম বিদ্বেষী একজন। যাকে নোবেল দিয়ে নোবেল কমিটি হয়তো খুব বেশি অনুতপ্ত। এতো বড় মিথ্যুক, ধর্ম ও বর্ণ বিদ্বেষী কেউ কখনো নোবেল পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। নোবেল পুরস্কার প্রদানের এক'শ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাসে, নোবেল পুরস্কার একজন ভুল মানুষের হাতে এসে পড়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। যে নোবেল জয়ী এতোটা বর্ণ বিদ্বেষী ভূমিকায় অবতীর্ণ। নিজের ক্ষমতা ও মসনদ রক্ষায় যে কিনা প্লটি দিতেও কসুর করেন না।

সুচি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণে ইনিয়া লেকের কোলঘেঁষা ইয়াঙ্গুন শহরের অভিজাত এলাকার লেকের পাড়ে ইউনিভার্সিটি এভিনিউয়ের ৫৪ নম্বর বাড়িতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ১৫ বছর নিঃসঙ্গ গৃহবন্দী দশায় কাটিয়েছেন। সুদীর্ঘ গৃহবন্দিত্ব আর গণতন্ত্রের পক্ষে আপোষহীন ভূমিকার জন্য তাকে বলা হতো এশিয়ার ম্যান্ডেলা।বর্ণবৈষম্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের কারণে নেলসন ম্যান্ডেলাকে যেমন কুখ্যাত রবেন দ্বীপের কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। যেখানে তিনি জীবনের ২৭টি বছর কাটিয়েছিলেন। তেমনি সুচিও ছিলেন একজন। তবে কোনও অর্থেই সুচির ভূমিকা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ছিল না। ১৯৯৫ সাল থেকে সুচির সঙ্গে পরিচিত ডেরেক মিচেল মিয়ানমারের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য প্রকাশ্যে বা ব্যক্তিগত পরিসরে সুচি কদাচিৎ সহানুভূতি দেখিয়েছেন। ম্যান্ডেলা বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ে জয়ী হবার পরও জাতিগত পুনর্মিলনের স্বার্থে সবাইকে কাছে টেনেছিলেন। তবে শতাধিক জাতিগোষ্ঠীর মিয়ানমারে সু চি কখনও কোনও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকারের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠ নিয়ে দাঁড়াননি। এমনকী দেখাননি সামান্যতম সহানুভূতি।

রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, বিতাড়ন ও হত্যার দায়ে মায়ানমার এখন গাম্বিয়ার মামলায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে। সেখানে তিনদিন ধরে চলা বিচারিক প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় দিনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে সুচি গণহত্যার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হয়ে মায়ানমারের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। রাখাইনে সহিংসতার কথা স্বীকার করলেও একে কোনোভাবেই গণহত্যা বলা যায় না বলেও মন্তব্য তার।

অং সান সুচি দাবি করেন, গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় রাখাইনের একটি খণ্ডিত ও বিভ্রান্তিকর চিত্র হাজির করা হয়েছে।এটি সুচির পুরনো ও বিভ্রান্তিকর কথা ছাড়া কিছু নয়। এরকম বয়ান তিনি আগেও দিয়েছেন তারই পুনরাবৃত্তি বৈকি। নির্জলা মিথ্যার আস্ফালন। মুলত:২০১২ সাল থেকে সুচির সমালোচনা হয়ে আসছে। রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গে অং সান সুচির নীরবতার কারণে এ সমালোচনা।২০১৩ সালের মার্চ মাসে বৌদ্ধ চরমপন্থিরা মেইকটিলায় কয়েক ডজন মুসলমানকে হত্যা করে। কাছের শহরগুলোতে দাঙ্গা, হত্যা, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। রয়টার্স লিখে, সুচি নিজে একজন অনুগত বৌদ্ধ। বৌদ্ধদের দ্বারা এমন সহিংসতার ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও তিনি নীরব থাকেন।

২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে। মায়ানমারের নিপীড়িত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর পলায়নও সুচি ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করেন।২০১২ সালে সাংবাদিকদের সুচি বলেন, রোহিঙ্গাদেরকে বার্মার নাগরিক বলে ভাবা যাবে কি না তা তিনি জানেন না। ২০১৩ সালে বিবিসির একজন মুসলিম সাংবাদিক মিশাল হুসাইনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে সুচি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা করেননি এবং মায়ানমারে মুসলিমদের জাতিগত নির্মূল হতে থাকার কথাও অস্বীকার করেন।

বরং জোর দিয়ে বলেন যে বৈশ্বিক মুসলিম শক্তি অনেক গ্রেট - এই বিশ্বব্যাপী কল্পিত ধারণার কারণে সৃষ্ট ‘আতঙ্কের আবহে’ই সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সুচি পরবর্তীতে যখন জানতে পারেন বিবিসির ঐ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিক মুসলমান ছিলেন এতে সুচি রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।।২০১৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সাথে আলাপকালে সুচি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি হিসেবে অভিহিত করেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত বইয়ে ডেভিড ক্যামেরন ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি নিয়ে যা লিখেন, সেখানে এমনটিই বলা হয়েছে।

২০১৫ সালের মে মাসে চতুর্দশ দালাই লামা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য সুচির প্রতি আহ্বান জানান এবং দাবি করেন যে তিনি এর আগে দুবার ব্যক্তিগত সাক্ষাতে সুচিকে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ভাবার জন্য বললেও সুচি তাতে গুরুত্ব দেননি। ২০১৬র মে মাসে সুচি মায়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েলকে বলেন যে রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ নামে উল্লেখ করা যাবে না, তারা ‘মুসলিম সংখ্যালঘু’। বার্মিজরা তখন মার্সিয়েলের রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল। ২০১৬-১৭ সালের নির্যাতনের সময় রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্ষা করতে ব্যর্থতা হওয়ায় সুচি অভিযুক্ত হন। লন্ডনের কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট ক্রাইম এক্সপার্টরা সতর্কবার্তা দিয়েছেন যে, সুচি মায়ানমারের ‘গণহত্যাকে আইনসম্মত’ হিসেবে দেখাচ্ছেন।

২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় ৬ লাখ থেকে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিগত তিন দশক ধরে মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে ৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আগে থেকেই বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অবস্থান করছে। ২০১৭ সাল থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চলতে থাকলেও, সেনাবাহিনীর সুপ্রমাণিত ধর্ষণ, খুন ও রোহিঙ্গা গ্রাম ধ্বংসের অভিযান বন্ধ করা তো দূরের কথা, সুচি সেসব স্বীকারই করছিলে না। ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মায়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘি লী রাখাইনের "বাস্তবিকই মারাত্মক" পরিস্থিতি নিয়ে সুচির প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন: "আইনের আওতায় সবাইকে সুরক্ষা দিতে এই ডি ফ্যাক্টো নেত্রীর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন - যেটা আমরা যেকোনো সরকারের কাছেই আশা করি।"
কিন্তু সুচির নীরবতা তখনো ভাঙ্গেনি।

সেই সময় শান্তিতে নোবেলজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু সুচির নীরবতার সমালোচনা করেেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এক খোলা চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, হে আমার বোন, মায়ানমারের রাজনৈতিক ক্ষমতার শিখরে পৌঁছানোই যদি তোমার নীরবতার কারণ হয়ে থাকে, তার জন্য সত্যিই বড় বেশি দাম দিতে হচ্ছে। ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হয়ে ওঠা একজনের জন্য এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দেওয়া বেমানান।

নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের কণ্ঠেও ভেসে আসে প্রতীক্ষার বাণী, মালালা বলেন তিনি মিস সুচির মুখ খোলার অপেক্ষায় আছেন। যিনি কিনা এই সংকট সৃস্টির পর কোনো মন্তব্য করেননি।" জর্জ মনবিও দ্যা গার্ডিয়ানে তার লেখায় সুচির নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চেঞ্জ ডট অর্গে একটি পিটিশনে সই করতে পাঠকদেরকে আহবান জানিয়েছিলেন এবং তিনি বলেন যে, পক্ষপাতিত্বই হোক বা ভয়েই হোক, সুচি অন্যদের স্বাধীনতার অধিকার অস্বীকার করছেন, যে স্বাধীনতা তিনি একসময় নিজের জন্যে চেয়েছিলেন। তার সরকার বাধা দিচ্ছে এবং কখনোবা নীরব থাকছে সেই অ্যাকটিভিস্টদের ব্যাপারে যারা তার নিজের অধিকার আদায় করতে সাহায্য করেছিলেন।

আরাকানে রোহিঙ্গা গণহত্যা’র আলামত মেলার পাশাপাশি ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও সুচির ভাষ্য থেকে মনে হয়, যেন কিছুই ঘটেনি। সেনাঅভিযান চলমান থাকতেই তিনি নরওয়ের সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, তা শেষ হয়ে গেছে।

দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার মতানুসারে, তার ‘রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের পক্ষে তিনি স্পষ্ট অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার জ্যোতির্ময় মহিমা বিদেশি মানবাধিকার লবিস্টদের সামনে পদস্খলিত হয়েছে।’

আন্তর্জাতিক মহলের উচিত হবে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা আমলে নিয়ে মায়ানমারকে কঠিন বার্তা দেওয়া। এখনই সময় বাংলাদেশে শরনার্থী হিসেবে বাস করা প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার দেওয়া।