অচলাবস্থার অবসান হচ্ছে বুয়েটে

প্রায় দুই মাস ধরে চলা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অবসান হতে চলেছে শিগগরিই। সোমবার রাতে র‌্যাগিং ও ছাত্র রাজনীতির সর্বোচ্চ শাস্তি চিরতরে বহিষ্কার নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির সব কটি পূরণ হলো। ফলে শিগগিরই শিক্ষার্থীরা ক্লাসে-পরীক্ষায় ফিরবেন বলে জানা গেছে।

গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। এরপর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি মেনে নেয়। সর্বশেষ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা। গত বুধবার বুয়েটের ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, তিন দফা দাবি পূরণ হলে আগামী ২৮ ডিসেম্বর থেকে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিতে তারা প্রস্তুত।

জানা যায়, গত ৬ অক্টোবর রাতে শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীদের নির্যাতনে আবরারের মৃত্যু হলে অনির্দ্দিষ্টকালের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে বুয়েট। শিক্ষার্থীদের ১০ দফার কয়েকটি মেনে নেওয়ার পর গত ১৫ অক্টোবর মাঠের আন্দোলন থেকে সরে আসে বুয়েট শিক্ষার্থীরা; তবে মামলার অভিযোগপত্র ও অন্য দাবিগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষায় না ফেরার ঘোষণা দেয়।

পাঁচ সপ্তাহের তদন্ত শেষে পুলিশ গত ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিলে ক্লাস-পরীক্ষায় ফেরার জন্য বুয়েট কর্তৃপক্ষকে আরও তিনটি শর্ত দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এসব দাবিগুলো হলো-অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার; আহসানউল্লাহ, তিতুমীর ও সোহরাওয়ার্দী হলের আগের র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় অভিযুক্তদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া এবং সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি ও র‌্যাগিংয়ের জন্য সুস্পষ্টভাবে বিভিন্ন ধাপে ভাগ করে শাস্তির নীতিমালা করে বুয়েটের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট থেকে অনুমোদন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্সে তা অন্তর্ভুক্ত করা।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সোমবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করায় আন্দোলনকারীদের সবগুলো দাবিই পূরণ হল। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভবিষ্যতে র‌্যাগিংয়ের সাথে জড়িতদের এবং সাংগঠনিক রাজনীতির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িতদের অভিযোগসমূহ মূল্যায়ন ও শাস্তি নির্ধারণ বিষয়ে গঠিত কমিটির রিপোর্ট এর আলোকে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে র‌্যাগিংয়ের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে তিন ধাপে। র‌্যাগিংয়ের কারণে কোনো ছাত্রের মৃত্যু হলে, গুরুতর শারীরিক ক্ষতি বা প্রতিবন্ধিতা তৈরি হলে, মানসিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হলে কিংবা শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে অভিযুক্তকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে বহিষ্কার করা হবে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কর্মকর্তা।

র‌্যাগিংয়ের নামে মৌখিক বা শারীরিক লাঞ্ছনা, অর্থ বা জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া, উত্ত্যক্ত করা, সাময়িক মানসিক ক্ষতি করা, হুমকি দেওয়া বা শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টার জন্য সতর্ক করা, জরিমানা করা, হল থেকে চিরতরে বহিষ্কার কিংবা একটি নির্দিষ্ট সময় শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার শাস্তি হতে পারে। পাশাপাশি অভিযুক্তকে ক্লাসে ফেরার আগে মনো-সামাজিক কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

র‌্যাগিংয়ের পরোক্ষ অংশগ্রহণ কিংবা র‌্যাগিংয়ের সময় উপস্থিতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগতদের কোনো কাজ করতে বাধ্য করার মত ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে সতর্ক করা, জরিমানা করা, হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা যাবে। পাশাপাশি তাকে বাধ্যতামূলকভাবে সোশাল সাইকোলজি বা এথিকস কোর্স করতে হবে।

আর যে কোনো মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাংগঠনিক রাজনীতিতে কারও সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পেলে, রাজনৈতিক সংগঠনের পদে থাকলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে মিছিল, মিটিং, পোস্টার টাঙানোর মত রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করলে রাজনৈতিক কর্মকা-ে কাউকে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করলে মাত্রা অনুযাযী সতর্ক করে দেওয়া, জরিমানা করা,সাময়িকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে বহিষ্কার করার সুযোগ থাকবে।

এর আগে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী, ২০ নভেম্বর আবরার হত্যায় অভিযুক্ত ২১ শিক্ষার্থীসহ মোট ২৬ জনকে বুয়েট থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এরপর র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার দুইটি হলের আরও ২৬ জন ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। শিক্ষার্থীদের তৃতীয় দাবিটি ছিল, সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি ও র‌্যাগিংয়ের জন্য সুস্পষ্টভাবে শাস্তির নীতিমালা প্রণয়ন করে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদন করে বুয়েটের অধ্যাদেশে তা সংযোজন করা। সোমবার সেই দাবিটিও পূরণ হয়েছে।

শিগগিরই বুয়েটের ক্লাস-পরীক্ষা অচলাবস্থার অবসান হতে যাচ্ছে বলে জানিয়ে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সকল দাবি মেনে নিয়েছি। ফলে ক্লাস-পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে আর কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, আমাদের সকল সিদ্ধান্ত নিতে একাডেমিক কাউন্সিলের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে। আগামী শনিবার মিটিংয়ের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। মিটিং থেকে পরীক্ষার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, যেটি পরে জানিয়ে দেয়া হবে। তবে আগামী ২৮ ডিসেম্বর টার্ম ফাইল পরীক্ষা তারিখকে সম্ভাব্য সময় ধরে আমরা কাজ করতে চাই। নির্দিষ্ট সময়েই পরীক্ষা শুরু করতে চাই।

এদিকে, শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, আগামী ২৮ ডিসেম্বর টার্ম ফাইল পরীক্ষার যে তারিখ ঠিক করা হয়েছে, এতে তারা অংশ নিতে ইচ্ছুক। কারণ পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় ক্ষতি তাদেরই হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে প্রশাসন সব শর্ত পূরণ করেছে। আগামী ২৮ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণে আর কোনও বাধা নেই। তবে আন্দোলনকারীরা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রতিক্রিয়ায় জানায়নি। বুধবার অথবা বৃহস্পতিবার তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন বলে জানা গেছে।