সুষম রহস্য উদঘাটন প্রকল্প || পর্ব-০৪

মহাত্মা গান্ধীর সামনে এইটা ছিল তাদের একটা প্রতিবাদ। কারণ, নোয়াখালীতে তহন (তখন) হিন্দু জমিদারেরা মুসলমান প্রজাদের খুব অত্যাচার করত। প্রায়ই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগত। কলকাতাতেও হাঙ্গামা লেগেই থাকত। মুসলমানরা বারবার মহাত্মা গান্ধীর কাছে প্রতিবাদ কইরা কোন ফল পাইতেছিল না।

মহাত্মা গান্ধীও এই দিকে আর নজর দিতে পারছিলেন না। কারণ, তখন তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলনে ব্যস্ত। অবশেষে কোন উপায় না দেখে নোয়াখালীর মুসলমানেরা অতিষ্ঠ হইয়্যা একজোট হয়। একে একে সব হিন্দুরারে বাইর করতে থাহে নোয়াখালীর মাডি (মাটি) থেইক্কয়া।

এইসব ঘটনা হুনার (শুনার) ফরে মহাত্মা গান্ধীর টনক নড়ে এবং তিনি নোয়াখালী আসেন। সময় মত না আওয়ার কারণে, যেইদিন তিনি আইছিলাইন সেদিন তাঁর সামনে থেইক্কেয়া ছাগল দুইডারে নিয়া জবাই কইরা আবার তাঁরেই দুপুরের খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয়। আসলে এইডা আছিল নোয়াখালীবাসীর একটা প্রতিবাদ আর কিছুই নয়।

হামিদ- যেরে (পরে) কি গান্ধী সাহেব ছাগলের গোশত খাইছিলাইন?
বখতিয়ার- জানি না।
গুলশান- হ বুঝছি। তোর নানীর বাড়ি নোয়াখালী দেইখে্খয়া তুই ঘটনা ঘুরায়া কইছছ। বখতিয়ার----- আরে না। ঘুরাই নাই। যা সত্য তাই কইছি।
শহুর আলী- ক ছে দেহি মহাত্মা গান্ধী মশাইয়ের আসল নাম কি আছিন?
গুলশান- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

সবাই একসাথে উচ্চস্বরে ‘সাবাশ’ বলে চিৎকার দিয়ে হাততালি দিল। খাসির মাংসের কথা চিন্তা করে ঘন ঘন ডুব গিলতে লাগল। ক্ষুধার্ত দেহে আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। প্রথমে সবাই রাজি না হলেও শহুর আলীর জোরাজুরিতে সবাই রাজি হলো। এখন ছাগলের কাছে গিয়ে তার দুধ পান করার পালা। আশেপাশে বাড়িঘর না থাকাতেই এমন সিদ্ধান্ত। কাজটি বিচিত্র হলেও সবার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে।

এদিকে ছাগল সাহেবানও ঘুরে ঘুরে গাছ খাচ্ছেন। তার সুঠাম আর সুষম দুধের স্তনগুলো দুলছেই তো দুলছে। সাথে তিনটে বাচ্চাও আছে। কে জানত হায় আজ ছয়জনের এক বিচ্ছুবাহিনী এই মাসুম ছাগলের বাচ্চাগুলোর দুধে ভাগ বসাতে যাবে? সূর্য তখন মাথার উপর লম্বভাবে অবস্থান করছে। সূর্যের ঝলমলে আলো ছাগলের কালো চামড়ায় খেলা করছে। আস্তে আস্তে সবাই এগিয়ে গেল নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খাওয়ারত ছাগল সাহেবানের নিকট।

সিদ্ধান্ত হলো গুলশান আর হামিদ ছাগলকে ধরে রাখবে, অন্যরা পালাক্রমে এর দুধ পান করবে, আর যে-কোন একজন ছাগলের বাচ্চাগুলোকে পাহারা দেবে। সকলের চোখে মুখে এক প্রকারের উত্তেজনা কাজ করছে। প্রথমে দুধ পান করবে শহুর আলী। যেইনা গুলশান আর হামিদ ছাগলের দু'পা ধরে রেখে ছাগলকে এক জায়গায় স্থির রাখার চেষ্টা করল, ঠিক তখনই ছাগলের তিনটি বাচ্চা সমস্বরে 'ম্যা ম্যা' করে চিৎকার শুরু করে দিল।

গুলশান ছাগলের মুখটা ভালো করে এক হাতে চেপে ধরে রেখেছে। কিন্তু ছাগলের অবুঝ তিনটি ছানাকে কোনভাবেই আর বুঝানো গেলো না। হঠাৎ পাশের ক্ষেত থেকে একজন মানুষের মাথা উঁকি দিল। তিনি হয়তো সেখানে কাজ করেছিলেন। গুলশানদের এরকম কাজ-কর্ম দেখে তার কেমন জানি সন্দেহ হলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন - এই যে মিয়াসাবরা। আফনেরা কিতা করতাছুইন? ছাগল ছুরি করুইন নাকি? একথা বলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের লোকজনকে ডাকতে শুরু করলেন। ক্ষুধার্ত গুলশান-বাহিনী মুহূর্তেই দৌড়ে পালালো।

আসলে খিদের জ্বালায় তারা কেউই এই লোকদের লক্ষ্য করেনি। অবশেষে তারা ইলইচ্চেয়ার বাজারে গিয়ে উপস্থিত হল। ছোটখাটো একটা বাজার। সব দোকানপাট বন্ধ। আজ শুক্রবার। সবাই নামাজের উদ্দেশ্যে দোকানপাট বন্ধ করে চলে গেছে। বাজারটি একটি গ্রামের এক পাশে অবস্থিত। গ্রামটির নাম রূপজান। বখতিয়ার আফরোজাদের গ্রাম পর্যন্ত চিনে। কিন্তু বাড়ি পর্যন্ত চিনে না। জুমার আজান হচ্ছে মসজিদে। সূর্যের প্রখরতা বাড়ছে ক্রমেই। পিপাসায় বুক ফেটে চৌচির সবার। বাতাস বন্ধ। গাছের একটা পাতাও নড়ে না।

মনে হচ্ছে রূপজান গ্রামের রূপের চেয়ে এর তেজই বেশি। সকলের মাথা ঝিম ঝিম করছে। শহুর আলী সবার উদ্দেশ্যে বলল- ঐ তোরা বিয়া বাড়ি খোঁজ। দেখ আইজ কোনো বাড়িতে বিয়ার গেট বানাইছে কি না? সবাই খোঁজ কর আমি কিছুক্ষণ গাছের তলে বইসা জিরায়া লই।

শহুর আলীর কথায় কেউ কান দিলো না। সবাই নিস্তেজ শরীর নিয়ে একটা বটগাছের তলায় হেলান দিয়ে বসে পড়ল। নিয়তি আজ সবাইকে লুকোচুরি খেলায় জব্দ করেছে। প্রকৃতির মতো এই ছয়জনের শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস একবার এইদিকে যায়, তো আরেকবার ঐ দিকে যায়। শরীর নিস্তেজ হয়ে রসহীন ছোট ছোট ডালের ন্যয় নুয়ে পড়েছে এখন। তবে হৃদপিণ্ডটা কাঁপছে বেশ দ্রুতগতিতে। কারণ, সকলেই খিদের জ্বালায় আজ উম্মাদ। এমন সময় ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে শহুর আলীর দিকে তাকাতে তাকাতে হন হন করে হেঁটে গেল এক গ্রাম্য কিশোরী।

তার চুলগুলো যেন ঘন মেঘের সন্নিবেশ। এই বুঝি বৃষ্টি হয়ে ঝরবে রূপজান গ্রামের উপর। কিশোরীর এক চোখে প্রশ্ন ছিল। কৌতূহল ছিল। আরেক চোখে সরলতা ছিল। কোমলতা ছিল। শহুর আলী এক লাফে উঠে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল দূরে মিলিয়ে যাওয়া কিশোরীর দিকে। তার মনে প্রেমলীলা জাগ্রত প্রায়। ক্ষণে ক্ষণে তা অসহনীয় খিদে দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

গুলশানের আর সইছে না যেন। প্রতিবার দম নেয়ার সময় মনে হয় খিদে আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়। কাউকে কিছু না বলে সামনে পা বাড়াল। নিঃশব্দে ছায়ার মতো সবাই তার পিছু পিছু আবার হেঁটে চলল। যে করে হোক, কিছু একটা তো খেতে হবে। জীবন বাঁচাতে হবে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। আফরোজার দেখা বুঝি আর পাওয়া হলো না তাদের। হঠাৎ শহুর আলী বলে উঠলো- আরে আফরোজার বিয়েতে তো আমরা কোন উপহার
লই নাই রে! এখন কি অইব?

সঙ্গে সঙ্গে গুলশান চোখ গরম করা উত্তর- তোর চিন্তা মনে হয় আমার চেয়ে বেশি? আগে কিছু একটা খাইয়্যা জানডারে বাছায়া লই। ঝিম ধরা নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে সবাই। এখন সবাইকে নদীভাঙ্গা শরণার্থীর মতো দেখাচ্ছে। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে মাঝে মাঝে কয়েকজন মেয়েলোক মুখে কাপড় গুঁজে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের দিকে তাকানো মাত্রই বাড়ালে চলে যায়। আলমাস বিড় বিড় করে বলতে থাকে- কেড়ে যে আইছলাম এই গরমের মরতাম। বাফরে বাফ!

অন্যরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। শুধু গুলশান নিরব হয়ে রইল। নীরবতা বরফের রূপ ধারণ করল। একটা বাড়ির পাশ থেকে একটা লাল রংয়ের শাড়ি চুরি করে এনে এটাকে ভাঁজ করে গুলশানের হাতে দিল শহুর আলী। ফিস ফিস করে কানের কাছে বলল- নে ধর। আফরোজারে তার বেয়ার উপহার দিস।

এমনিতেই খিদের জ্বালায় নাড়ী-ভুরি উল্টে যাচ্ছে সবার। তার ওপর শহুর আলীর এমন অদ্ভুত ফাজলামি সহ্য হলো না গুলশানের। সে খুব রাগী প্রকৃতির তা সবাই জানে। শহুর আলী তো আরও বেশি জানে। সেই সবচেয়ে বেশি মার খায় গুলশানের হাতে। গুলশান টগবগে গরম পানির মতো ফুটছে।

চোখ দিয়ে মনে হয় আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে। শহুর আলীর এবার আর নিস্তার নেই বুঝি। ক্ষিপ্র আর ক্ষুধার্ত বাঘের মতো থাবা বসিয়ে দিচ্ছিল শহুর আলীর উপর। ঠিক সেই সময় হেমিলিওনের বাঁশির মায়াবী আওয়াজ ভেসে এলো সবার কানে- এই তোরা এদিকে আয়। আর সামনে যাইসনা ফকিরের দল।

সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা হরিণের মত সকলের কান খাড়া হয়ে গেল। ডাকল কে? চেনা এক কন্ঠ! তারপরও অচেনা লাগছে। যিনি ডাকছেন দূর থেকে শুধু তার সাদা-শুভ্র দাঁতগুলোই ভাসছে। সূর্যের বিপরীতে সেগুলোতে সূর্যালোকের প্রতিফলন ঘটছে দ্রুত। মোটাসোটা শারীরিক গড়ন দেখে তাকে চিনতে আর ভুল হলো না কারণই। এ যে দেখি আফরোজা! শহুর আলী ক্যাঙ্গারুর মতো কয়েকটা লাফ দিল। কাছাকাছি এসে সবাই আফরোজাকে ভাল করে চিনে নিল। আফরোজাও অট্ট হাসিতে কাঁপিয়ে তুলল চারপাশ। এটাই আপনাদের বাড়ি। গুলশান মিটমিট হাঁসছে।

একবার আফরোজার দিকে তাকায় তো আরেকবার আকাশের দিকে তাকায়। ঘন ঘন সে ডান হাত দিয়ে মাথায় চুল গুলোকে পিছনের দিকে মাড়িয়ে নিচ্ছে। আফরোজার সামনে একটু নায়ক নায়ক ভাব নেয়া ছাড়া আর কিছুই নয় এটি। আকাশী রঙের শাড়ী পড়ে আঁচলটা কোমড়ে গুঁজে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফরোজা। দুই হাতে গোবর আর কাদা মেশানো। বোঝা যাচ্ছে যে সে ঘর-দুয়ার লেপে দিচ্ছিল। এটা গ্রাম বাংলার খুবই পরিচিত দৃশ্য। মহিলারা বছরে এক দু'বার করে ঘর দুয়ার লেফে দেয়। ফলে মাটির উপরিভাগ মসৃণ হয়। মোলায়েম হয়। ধান চড়াতে সুবিধে হয়। এবার সকলের হুঁশ হলো। (চলবে) [আলোচিত গল্পটি মো. মাহফুজুর রহমানের ‘রাজহংসী বধ’ গল্পের বই থেকে নেওয়া।]

লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ