আগে বললেই হত, স্বপ্ন নিয়ে ঢাবিতে আসতাম না

গণরুম ও শাহ জাহান তানিম

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ একটি মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত সেটা হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই। এই অমিয় বাণী কতটা কার্যকর তা দেখতে আমি বাংলাদেশের মানুষকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমগুলো ভিজিট করার পরামর্শ দিব। এখানে আসলে আপনারা দেখতে পাবেন যারা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা তারা থাকেন সিংগেল রুমে আর সাধারণ শিক্ষার্থীরা এক রুমে বিশ-ত্রিশ জন করে থাকেন। দুটো জিনিস তুলনা করলেই বুঝা যায় উপর্যুক্ত ফাঁপা বুলিটি আসলে কতটা অকার্যকর আর অপ্রাসঙ্গিক! এখানে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা মাস্টার্স শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অবৈধভাবে এক রুমে একজন করে থাকেন আর আমরা বৈধ শিক্ষার্থীরা সেখানে এক রুমে বিশ-ত্রিশ জন করে থাকি।

একটি ছোট রুমে বিশ-ত্রিশ জন করে থেকে, বস্তির পরিবেশে থেকে আমাদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। অথচ নেতারা অবৈধভাবে সিংগেল রুম দখল করে আছেন। এই পরিবেশে থেকে পড়াশোনা করে আমরা নাকি বাঙ্গালী জাতির নেতৃত্ব দিব, আমরা নাকি বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সহায়তা করব! এভাবে জাতির মেধাবী সন্তানদেরকে গণরুমে রেখে যে জাতি স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সেই জাতির একজন অংশীদার হিসেবে আমি লজ্জা অনুভব করি। এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ষোল কোটি মানুষের ট্যাক্সের টাকায় চললেও এখানে যদি আপনি ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের অন্যায় অনিয়মের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকার অধিকার আপনার নেই! আপনি ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন সমর্থন করলে আপনি সকল সুবিধা পাবেন, ক্যাম্পাসে আপনার নিরাপত্তা থাকবে। আর যদি আপনি তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমর্থন করতে না পারেন তাহলে আপনাকে হল থেকে নামিয়ে দেওয়া হবে। আমার প্রশ্ন, যদি এমন অন্ধ দলীয় অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় চলে তাহলে সেটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাম পরিবর্তন করে "বাংলাদেশ (ক্ষমতাসীন দল) বিশ্ববিদ্যালয়" ঘোষণা করে দিলেই হয়। তাহলে আমরা স্বপ্ন নিয়ে এখানে পড়তে আসতাম না।

হলগুলোতে গেস্টরুম নির্যাতনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে সকল অনিয়ম, অন্যায় মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমর্থন করানোর চর্চার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতিকে মেরুদণ্ডহীন করে তোলা হচ্ছে, ফলস্বরূপ আমরা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবো তখন উর্ধতন কর্মকর্তার বৈধ-অবৈধ সবকিছুই সহমত ভাই চর্চার রীতি অনুযায়ী মেনে নিতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠব। যতদিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে গেস্টরুম গণরুমের কালচার বন্ধ না করা হবে ততদিন এই জাতি মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারবেনা, বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো তো অনেক পরের কথা। ক্ষমতাসীন দল যতই চাপাবাজী করুক যতদিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধীনতা তথা সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বৈধ সিটের অধিকার, সুষ্ঠুভাবে পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিত করা না হবে ততদিন পর্যন্ত এই জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।

দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে নিজের মেধা যাচাই করে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থীকে কেনো এভাবে অত্যাচার নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে? ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পাওয়া একজন শিক্ষার্থী কখনই এগুলো মেনে নিতে পারেনা। এই গেস্ট রুম কালচারের কারণে ক্লাস রেখে আমাদেরকে বাধ্য করা হয় রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য। গেস্ট রুম নির্যাতন নিয়ে আমার টাইমলাইনে একটি হতাশাব্যাঞ্জক পোস্ট করায় সেদিন রাতে আমাকে সিঙ্গেল গেস্টরুমের শিকার হতে হয় এবং আমাকে তাদের টর্চার সেলে নিয়ে ক্রিকেট স্ট্যাম্প নেওয়া হয় পেটানোর জন্য! কিন্তু কেনো? স্বাধীন দেশে একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য আবরারের জীবন গেলো, আমাকে স্ট্যাম্প নির্যাতনের শিকার হতে হলো! কিন্তু কেনো? একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য কাউকে স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো হয় আর কাউকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলা হয়! আমাদের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে তাদের এতো মাথা ব্যাথা কেন!? সত্যের পথে থাকলে নিশ্চয় এগুলো নিয়ে এতো ভয় থাকতো না। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের এই নির্মম থাবা থেকে রাষ্ট্রের নির্বাহীগণ আমাদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

এই রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা এই রাষ্ট্রের নির্বাহীগণ আমাদের নিরাপত্তা দিতে এতোটুকু ব্যর্থ কেন? তারপরেও তাঁরা গর্বের সাথে বলে, "আমরা একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে সহায়তা করছি"। এগুলো আসলে ফাপাবুলি ছাড়া কিছু না। আমরা তথা বিশ্ববিদ্যালয় লেবেলের শিক্ষার্থীরা যারা একদিন এই দেশের নেতৃত্ব দিবে, তারা যদি সুষ্ঠুভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা না পায় এবং অন্যায়ভাবে বড় ভাইদের সহমত চর্চা তথা নোংরা রাজনীতির চর্চাকে সমর্থন করে বড় হতে হয়, আমরা যদি এক রুমে যেখানে পাচঁজন থাকার কথা নেতারা সেখানে একজন থাকেন আর আমরা সেখানে ত্রিশজন থাকি! কিন্তু কেন? নেতারা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়েছে, আমরা কি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পাইনি? তাহলে " বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যর ঠাঁই নাই" এই কথা যদি এভাবে বাস্তবায়ন করার বা এই ফাপাবুলি যদি সমাজে ছড়ানোর ইচ্ছা থাকে তাহলে এই বৈষম্য এবং আপনাদের কথা কতোটুকু কন্ট্রাডিক্টরি সেটা জাতির কাছে আমার প্রশ্ন থাকলো।

এই জাতিকে, এই জাতির মেধাকে গেস্টরুম, গণরুম নামক কালাচারের মাধ্যমে গলা টিপে হত্যা করার যে ষড়যন্ত্র চলছে তার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে আমি আহ্বান করবো মেরুদণ্ড শক্ত করে এর প্রতিবাদ যদি না করতে পারেন, শুধু নিজের চাকরি হবে, আপনি বিসিএসে এডমিন ক্যাডার হবেন, পুলিশ ক্যাডার হবেন, একটা রাষ্ট্রের গোলাম হবেন। আপনি কখনো সুষ্ঠু মেরুদন্ডের মানুষ হতে পারবেন না। আপনার দ্বারা এই দেশ ও জাতি কখনো ভালো কিছু আশা করতে পারবে না। আপনি যখন এই বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, আপনি সর্বোচ্চ একটা সরকারি চাকর হতে পারবেন। আপনি মানুষের একজন সেবক কখনোই হতে পারবেন না।

এই সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্যর ধারক-বাহক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ঢাবির সকল শিক্ষার্থীদেরকে আমি আহ্বান জানাবো আসুন, আমরা হাতে হাত রেখে, কাধে-কাধ মিলিয়ে গোটা বাংলাদেশকে এই নোংরা রাজনীতির চর্চা থেকে মুক্ত করতে সহায়তা করি।

দেখেন, আমি এককভাবে কথা বললে যা হয় বা হবে, আপনারা যদি সকলে একসাথে ভয়েস রেইজ করেন তাহলে বাংলাদেশের কোনো সংগঠনের কোনো ক্ষমতা নেই সকলকে একসাথে দমিয়ে দিবে। আমরা ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী আছি, সকল শিক্ষার্থী যদি একসাথে অধিকারের পক্ষে কথা বলি তাহলে কারো কোনো ক্ষমতা নেই আমাদেরকে দমিয়ে দেওয়ার। আমরা এই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এতটুকু অধিকার আমাদের আছে।

বাক-স্বাধীনতা তথা একজন ছাত্র হিসেবে হলে থাকার স্বাধীনতা এবং প্রথম বর্ষের একজন ছাত্র হিসেবে আমার যে বাক-স্বাধীনতা এবং বৈধ সিটের অধিকার সেটা নিশ্চিত করা এবং সকল অধিকার নিশ্চিত করা যতদিন পর্যন্ত না হচ্ছে; চলুন আমরা এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং বাংলাদেশকে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করি।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক, বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়