সুষম রহস্য উদঘাটন প্রকল্প || পর্ব-০২

গুলশান- ঠিক আছে। কালকে আমরা এই শালির বাড়িতে যাইবাম। দেখবাম আসলেই কি হের বিয়া নাকি। আর দাওয়াত যেহেতু দিছে তাইলে তো আমরা যাইতেই পারি। নাকি? এই বলে গুলশান তার পকেট থেকে একটা অর্ধ-বৃত্তাকার সরু তারের দন্ড বের করল। এটা মূলত সাইকেলের চাকার মাঝখানের চিকন অনেকগুলো সরু তারের মধ্য থেকে একটি।

স্থানীয় বাসায় একে বলে ‘শিক’। এর এক মাথায় ছোট্ট একটি খোপে কিছু বারুদ ঢুকানো থাকে। এটা কে বাঁকিয়ে অর্ধ-বৃত্তাকার করে এর আরেক মাথায় সুতলী দিয়ে বাঁধা একটি চিকন লোহা এনে এই বারুদ সমৃদ্ধ খোপে ঢুকিয়ে এটাকে একসাথে শক্ত কোন ধাতব পদার্থের গায়ে আঘাত করলে বারুদ বিস্ফোরিত হয়ে জোরে আওয়াজ হয়।

বারুদ সংগ্রহ করা হয় দিয়াশলাইয়ের কাঠির মাথা থেকে। এটা লোহিত ফসফরাস। সব মিলিয়ে এটা এক ধরনের খেলনা। গুলশান সেটাকে একটা পাথরে সজোরে আঘাত করতেই ঠাস করে আওয়াজ হয়ে সেটা থেকে হালকা সাদা ধোঁয়া বের হলো। সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাঁচজন তাদের পকেট থেকে এই বিচিত্র খেলার বস্তুটি বের করে একসাথে পাথরে আঘাত করে পাঁচগুণ বেশি আওয়াজের অবতারণা করল।

পরদিন সূর্য ওঠতে তা ওঠতেই তারা ঘুম থেকে ওঠে গেল। কালবিলম্ব না করেই তৈরি হতে লাগল সবাই। যেতে হবে বহুদূর। আফরোজাদের বাড়ি। রাতের অন্ধকারের পর ঝলমলে আলো ফোটার আগেই তারা তাদের দাঁত মেঝে ঝকঝকে করে ফেলল। মোরগের সকাল বেলার ঘুম ভাঙানো 'কু ক্কু রো কুক' আওয়াজ শোনা আগেই তাদের গলার গর গর আওয়াজ বাতাসে ভাসতে লাগল। সবাই পানি নিয় গরগরা করছে। সকালের নির্মল প্রকৃতির সাথে যেন এক প্রতিযোগিতা চলছে এই ছয় জন দুরন্ত বালকের। রাখাল ভাইয়েরা মাঠে গরু নিয়ে বের হওয়ার আগেই বেরিয়ে পরল তারা। তারা সবাই রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের সন্তান। ফজরের নামাজ বাদ দেওয়া যাবে না। তাই সবাই মিলে কলেজ মসজিদের মুয়াজ্জিন কে ডেকে তুলল। মুয়াজ্জিন সাহেব আজান দেয়ার আগেই মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজান দিয়ে দিলে গুলশান। তার আর দেরি সইছে না। ইমাম সাহেব আসার আগেই মুয়াজ্জিনকে ইমাম বানিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল দুর্ধর্ষ বালকের এই দল। মুয়াজ্জিন সাহেবও বয়সে তাদের কাছাকাছি। মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সে অত্র কলেজেই ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাই সে আর গুলশানদের সাথে পেরে উঠল না। তাদের কথা মানতে বাধ্য হলো।

এবার যাত্রা করার পালা। কিছুদুর যাওয়ার পর দলনেতা গুলশান কি মনে করে আবার ফিরে আসলো মসজিদের বারান্দায়। অন্য সবাই ও তার পিছু পিছু কৌতূহল নিয়ে ফিরে আসল। এবার গুলশান বলল- কোথাও যাওয়ার আগে ডান পা দিয়ে বের হতে হয়। না হলে আদবের বরখেলাপ হয়।

সঙ্গে সঙ্গে শহুর আলী বলল- ধুর বেডা! মসজিদ থেইক্কেয়া বাইর অইলে তো আগে বাম পা দেয়া লাগে। হুজুর রে জিগায়া দেখ। গুলশান কিছু না বলে বিরক্তির ভাব নিয়ে মাথা নাড়ল। আবার সামনে এগুতে লাগলো। শহুর আলীকে জিজ্ঞেস করল -কোথাও বের হওয়ার সময় কোনো দোয়া পড়া লাগে তা জানস?
শহুর আলী জবাব দিল-না-হ।
শহুর আলী অন্যদের জিজ্ঞাস করল -এই তোরা জানাস?

সবাই না বলে মাথা নাড়ল। এবার তারা কৌতুক করার কৌতুহল সংবরণ করতে পারলো না। একে একে গুলশানকে বলতে লাগল- আহ! লাগে যেন তুই বিয়া করতে যাইতাছছ! শুভ কাজ করতে যাইতাছছ! বউ তুল্লেয়া লইয়্যা আইবে মনে অয়? হালা হালা!

হাঁটছে ছয়জন বালকের একটি কাফেলা। নেতৃত্ব আছে গুলশান। নরসুন্দা নদীর একধার ধরে পূর্ব দিকে হেঁটে যাচ্ছে গুলশান - বাহিনী। সূর্যের বিপরীতে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আরও ছয়জন ছায়া। নরসুন্দার বুকে বিরাজমাননৌকার সারি দেখা যায় মাঝে মাঝে। আর তখন এরা সবাই হাত তুলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেয় নৌকার মাঝিদের লক্ষ্য করে।মাঝিরাও প্রওোতরে 'হেই' বলে আওয়াজ দেয়। এটা তারা এমনিতেই করে। করে মজা পায়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এরকম বিচিত্র মধুর রীতির চর্চা। নরসুন্দার চলমান স্রোতের মাঝে সোনালি রৌদ্র প্রতিফলিত হয়ে ঝিলিক মারছে বারবার।তা দেখে গুলশানের চোখ দু'টোও ছল ছল করে।সে নরসুন্দার হাঁটুজলে নেমে পরে। অন্যরা থমকে দাঁড়ায়। বেলা বয়ে যাচ্ছে নরসুন্দার স্রোতের মতো। গুলশান ক্ষণিকের জন্য নদীর জলে নিজের মুখ দেখে নেয়। উঁচু গলায় গেয়ে ওঠেথ...

বদনাম হবে জেনেও তবু ভালোবেসেছিলাম
ঐ চাঁদমুখে কলঙ্ক আছে, আমি তাও জেনেছিলাম।


সঙ্গে সঙ্গে শহুর আলী গেয়ে ওঠল- প্রেমের মরা জলে ডুবে না। শানু পাগলা জলে ভাসে না। আওয়াজটা বাঁশ পাতার বাঁশির মতো শুনাল। সবাই হো হো করে হেসে দিল। গুলশানের বোধহয় এই পরিহাস সহ্য হলো না। সে সঙ্গে সঙ্গে শহুর আলীকে ধরার জন্য এগিয়ে আসল। শহুর আলীও শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দিল এক দৌড়। একবার ধরা খেলে যে রক্ষে নেই! আবার বুঝি সে নিক্ষিপ্ত হবে নরসুন্দার গর্ভে। নদীর তীর ঘেঁষে ভেজা বালুর উপর তাদের এই দৌড়াদৌড়ি দেখে হামিদ, আলমাস, বখতিয়ার আর দুলালও এতে যোগ দিল। একটা সময় শহুর আলী আর পেরে উঠল না। গুলশান তাকে ঝাপটে ধরে বালুর উপরই গড়াগড়ি দিল। শহুর আলীও বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার শুরু করল। হঠাৎ কি মনে করে গুলশানকে বললথ আচ্ছা শানু। খেয়াল করছছ? (চলবে)

(আলোচিত গল্পটি মো. মাহফুজুর রহমানের ‘রাজহংসী বধ’ গল্পের বই থেকে নেওয়া।)

লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ।