মাছ ভর্তায় বড়শি আন্দোলন, নেপথ্যে ছাত্রলীগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হলের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) দুপুরে আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ডাইনিংয়ের মাছ ভর্তায় ‘মাছ ধরা বড়শি পাওয়ার অভিযোগে আন্দোলন করা হয়। তবে অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ভর্তায় ‘মাছ ধরা বড়শি পাওয়ার অভিযোগে’ আন্দোলনটি পুরোটি সাজানো।

সেদিন আন্দোলনের এক পর্যায়ে হলের সিসিটিভি ক্যামেরা, চেয়ার, বেসিন ও ডাইনিংয়ের আসবাবপত্র ভাঙচুর করেন তারা। হল কতৃপক্ষের দাবি এতে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে কেন তাদের এই আন্দোলন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁতে গিয়ে দেখা যায়, গত ৭ আগস্ট হল বন্ধের আগের দিন লতিফ হলের পশ্চিম-উত্তর ব্লকের পশ্চিমের জানালার গ্রিলসহ ২ ইঞ্চির ২০ ফিট লম্বা ৪টি লোহার পাইপ চুরি হয় যার বাজার মূল্যে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা।

এরই মধ্যে শুরু হয়েছে হলটির নানান সংস্কার কাজ। কোটি টাকার কন্সট্রাকশনের সে কাজের ঠিকাদারদের কাছ থেকে ভাগ না পাওয়া, অবৈধ সিট বাণিজ্যের সুযোগ না পাওয়া, শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ চুরিগুলোকে আড়াল করতেই মূলত তাদের এই সাজানো আন্দোলন। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্যে জড়িত একটা স্থায়ী সিন্ডিকেট। সে অপরাধ কর্মকাণ্ডগুলোর থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই এই আন্দোলন এমনটাই মনে করছে হল সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, গত ২০ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) বেলা সাড়ে ১২টার সময় আন্দোলন শুরু করে হলের কিছু শিক্ষার্থী। অভিযোগ ছিল— ‘মাছ ভর্তায়’ মাছ ধরার বড়শি পাওয়া গেছে। আন্দোলন শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় ডাইনিংয়ের কার্যক্রম। স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিনের খাবার বিক্রি করতে সময় লাগে ১২টা থেকে অন্তত ২টা পর্যন্ত। কিন্তু সেদিন আন্দোলনের কারণে খাবার বিক্রি বন্ধ থাকলেও দুপুর ২টার পরে হলটির ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখা যায় সামান্যকিছু ছড়ানো ছিটানো ভর্তা বা ভাত ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভর্তায় বড়শি পাওয়ার অভিযোগ তুলেন মো. ইমরান হোসেন। আর আন্দোলনে যাদের নেতৃত্বে দিতে দেখা যায় তারা হলেন, ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র শাহরিয়ার সজল (সিট বাণিজ্যের সাথে জড়িত) ও মাসুম, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের আব্দুল্লাহ আল মামুন নির্ঝর (সিসি ক্যামেরা ভাঙ্গার সাথে জড়িত), লোক প্রশাসনের মাস্টাসের শিক্ষার্থী আবু বকর খান, গণিতের অমিত মন্ডল, রাজিব। এর সকলেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।

এদিকে ভর্তায় ‘মাছে ধরা বড়শির’ বিষয়ে হলের আবাসিক শিক্ষক, সাইফুর রহমানকে আহ্বায়ক, ড. আব্দুল হালিম এবং ড. ছালেকুজ্জামান খানকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছিলেন প্রক্টর অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান।

এই কমিটির প্রতিবেদন বলছে, ঘটনায় অভিযোগকারী শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন তদন্ত কমিটির কাছে দাবি করেছেন বড়শিটি ভর্তার মধ্যে ছিল। তা দিয়ে খাওয়ার সময় ৩য় লোকমায় তার মুখে চলে আসে। তদন্ত কমিটিকে তিনি জানিয়েছেন, এতে তার মুখে কোন ধরনের আঘাত বা ক্ষত হয়নি। এদিকে মাছ ভর্তা করার সাথে জড়িত কর্মচারীদের ভর্তা করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তদন্ত কমিটিকে দেয়া ভাষ্য বলছে ভিন্ন কথা।

তদন্ত কমিটির ভাষ্য মতে ১ দশমিক ১ ইঞ্চির বড় একটি বড়শি ভর্তাতে (হাত দিয়ে মাছ টুকরো করা, পরিষ্কার করা, তেলে ভাজা এবং শিল-পাটায় পেস্ট করা) এই প্রক্রিয়ায় দেখা যাওয়ার কথা। অথবা হাত দিয়ে মিশ্রণ করা, পরিবেশনের জন্য গোলাকার পিছ করার সময় হাতে বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এমনকি তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে সে বড়শি কোনভাবে বিকৃতও হয়নি। সার্বিক বিশ্লেষণে তদন্ত কমিটি মনে করে মাছ ভর্তায় বড়শি পাওয়ার ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

লতিফ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. একরাম হোসেন বলেন, এ বিষয়ে আন্দোলনকারীরা যে দাবিগুলো জানিয়েছিল— সেগুলো আমি দায়িত্ব নেয়ার পরেদিন থেকে কাজ শুরু করেছি। এর মধ্যে হলের ১২-১৩টি প্রজেক্টের কাজ এখনো চলমান। মূলত আমার এই কাজগুলোকে বাধাগ্রস্ত করতেই এই আন্দোলন।

হলে গিয়ে দেখা যায়, দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোজন করা হয়েছে (১২ টি অ্যাকসেস পাওয়ার পয়েন্ট), বাতরুমের দরজা-জানালা সংস্কার, বিভিন্ন রুমের নতুন-দরজা লাগানো, ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেটা এর আগে কখনো হলে ছিল না, গভীর নলকুপ (সাবমারসিবল পাম্প) বসানো হয়েছে। তাছাড়া চলমান রয়েছে, তৃতীয় তলার উত্তর ব্লকের নতুন ছাদ তৈরীর কাজ, ১৯টি বাথরুমে টাইলস বসানো, আধুনিক অতিথি কক্ষ তৈরী, প্রভোস্ট রুম-ওজু খানায় টাইলস বসানো, বঙ্গবন্ধু পাঠাগার তৈরীর কাজ। প্রস্তাবিত কাজের মধ্যে রয়েছে রিডিং রুম তৈরী, হলের অডিটোরিয়াম আধুনীকরণ, মসজিদ সংস্কার, পুরো হল রং করা, তৃতীয় তলার পূর্ব ব্লকের নতুন ছাদ তৈরির কাজ।

এ বিষয়ে হলটির আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, স্যার আসার পর থেকে হলে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। বিগত দুই প্রভোস্ট হলের দায়িত্ব পালন করলেও তারা নূন্যতম কোন কাজ করেনি। কিন্তু স্যার দায়িত্ব নেয়ার একমাসের মাথায় দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোজন করাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূল কাজ হাতে নিয়েছে। যার মাধ্যমে হল পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে আমরা আশাবাদী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থী জানান, কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার কারণে হলের উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এই নেতাদের মধ্যে নির্ঝর, শাহরিয়ার সজল ছিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজির সাথে জড়িত।

তবে হলটির ছাত্রলীগের নেতা শাহরিয়ার সজল ও নির্ঝর দাবি করেন, ‘হল প্রভোস্ট নিজের গাফিলতি এবং আরো অনেক গাফিলতি ঢাকার জন্য এমন শিক্ষকদের দিয়ে এমন তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করিয়েছেন।’