বুয়েট শিক্ষকের গবেষণা প্রকল্পে ছাত্রলীগের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র

সেই প্রজেক্টের ওয়েবসাইট

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানা নির্যাতনের চিত্র বেরিয়ে আসছে। গত কয়েকদিনে সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুয়েটের সাবেক ও বর্তমান অনেক ভূক্তভোগী এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন।

এবার বুয়েটের সিএসই বিভাগের অনলাইনভিত্তিক একটি গবেষণা প্রকল্পে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে। ‘ইউ-রিপোর্টার’ নামে ওই গবেষণা প্রকল্পে অনেক সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের ভয়াবহ নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন।

জানা গেছে, অনলাইনের মাধ্যমে কিভাবে বিভিন্ন ধরণের সহিংসতা রোধ করা যায় অথবা কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে তা কিভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে এই প্রজেক্ট। সিএসই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ. বি. এম. আলিম আল ইসলাম এই প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন।

সম্প্রতি বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর ওই প্রজেক্টে ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা শেয়ার করার সুযোগ দেয় ‘ইউ-রিপোর্টার’। অভিযোগকারীর নাম-পরিচয় গোপন থাকা শর্তে সেখানে বিভিন্ন সমস্যা শেয়ার করতে পারবে। তারা আবার এসব সমস্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তানান্তর করেন। বুধবার রাত পর্যন্ত সেখানে দেড়শরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে।

এ বিষয়ে বুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের (সিএসই) বিভাগীয় প্রধান ডঃ মোঃ মোস্তফা আকবর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা আমাদের বিভাগের একজন শিক্ষকের রিসার্চ প্রজেক্ট। অনলাইনে রিপোর্টিংয়ের (অভিযোগ) মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের সহিংসতা কিভাবে কমানো যায়, সেই বিষয় নিয়ে এখানে কাজ করা হচ্ছে।

বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ. বি. এম. আলিম আল ইসলাম এই রিসার্চ প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন। মুঠোফোনে তার সঙ্গে যোগযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি।

‘ইউ-রিপোর্টার’-এ কম্পিউটার সাইন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক সাবেক ছাত্র লিখেছেন, টিউশনি করে নজরুল ঢুকেই শুনতে পেলাম গগনবিদারী আর্তনাদ। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম পরিচিত একজনকে মারা হচ্ছে। শুভ্র জ্যোতি তাকে মাটিতে ফেলে মুখমন্ডলে লাত্থি দিচ্ছে। তারপর মোটা বাটাম নিয়ে এসে গায়ের সর্বশক্তি পিটাতে লাগল শুভ্র। ক্যান্টিন থেকে লবণ নিয়ে এসে দিল ০৭ এর তন্ময় ভাইটির রক্তাক্ত মুখে লাগিয়ে দিলো। এরপরে আর সহ্য করতে না পেরে হলে চলে আসি। যতদিন ক্যাম্পাসে ছিলাম, শুভ্র জ্যোতির দিকে তাকালেই তার সেই নৃশংস চেহারার কথা মনে পড়ত।

আরেক ছাত্র জানান, আমাকে তিতুমীর হলের ২০০৬ নাম্বার রুমে ডেকে নিয়ে যায় ১২ ব্যাচের জাওয়াদ। সেখানে ০৯ এর শুভ্র টিকাদার, ০৯ এর সিয়াম , ০৯ এর শুভম , ১০ ব্যাচের কনক, রাসেল আর ১১ ব্যাচের তানভীর রায়হান আজগুবি ভাবে আমাকে শিবির প্রমাণ করার চেষ্টা করে। প্রথমে তানভীর আমাকে গালে প্রচন্ড এক থাপ্পড় মারে। থাপ্পড়ে মাথা ঘুরে পড়ে আমার ঠোট কেটে যায়। এরপর তানভীর আমার বুকে প্রচন্ড এক লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। এরপরও আমি শিবির করিনা বলায় মাথায় একটা বস্তা বেধে দেয়। এরপর শুধু মুহুর্মুহু রডের বাড়ি পড়তে থাকে পিঠের উপরে। একজন টায়ার্ড হয়ে রডটা রাখতেই আরেকজন রড হাতে তুলে নেয়। এভাবে প্রায় ১ ঘন্টা বস্তাবন্দী থাকার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। শূভম এসে আমার পা ভেংগে ফেলার পরামর্শ দেয়। পরামর্শ শুনে কাজল আর রাসেল মিলে আবার পূর্নোদ্যমে আমার পা লক্ষ্য করে রড দিয়ে পিটানো শুরু করে। ওরা কোন কারণে আমার উপরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমাকে চলে যেতে বলে। যাওয়ার সময় হলের গেটে আমাকে বলে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি রাস্তায় এক্সিডেন্ট করছিস। পাঁচবার আমাকে দিয়ে মিথ্যা উত্তর প্র্যাকটিস করিয়ে রাত তিনটায় ছেড়ে দেয়। তারপর আমার চাচার বাসায় চলে যাই। এরপরের বুয়েটের বাকি সময়টা একটা ট্রমা নিয়ে কাটিয়েছি। অভিযোগের ব্যাপারে জাওয়াদ জানিয়েছে, আমি এরুপ কোন ঘটনার সাথে কোনভাবেই জড়িত নই। অন্য কারো কথা বলতে গিয়ে ভুলবশত আমার আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ দাতা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উভয়কেই অনুরোধ করব ভবিষ্যতে তথ্যেও ভেরিফিকেশনে একটু সতর্ক থাকার জন্য। কারণ কারো ছোটোখাটো ভুল অন্যের ব্যাপক ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তিতুমীর হলের ১৮ ব্যাচের এক ছাত্র জানান, হলে উঠার পর থেকেই নিয়মিত থাপ্পড় খাওয়া, ক্লাসমেটকে দিয়ে আরেক ক্লাসমেটকে মারানো, অসংখ্য বার কানধরে উঠবোস। যা করতে করতে আমরা হাঁটতেও পারতাম না কয়েকদিন। একবার আমাদের হলমেটদের কয়েকজনকে ছাদে তোলা হয়। আমাদের একজনের দোষ ছিল সে বড় ভাইদের না বলে মাবাবাকে কমন রুমে নিয়ে এসেছিল। আরেকজন মিছিলে না গিয়ে মুভি দেখতে গিয়েছিল, একজন টিউশনিতে ছিল, একজন ডিপার্টমেন্টে বড় ভাইকে সালাম দেয় নাই। এরপর ১৭ এর ভায়েরা আমাদের সবাইকে স্ট্যাম্প দিয়ে মারতে থাকে। আমাদের ইইই এর এক ফ্রেন্ড মার খায় সবচেয়ে বেশি। কারণ সে মার খেয়ে টলে পড়ছিল না। ভাইয়েরা মারতে মারতে বলে- শালা ব্যায়াম করে,ব্যায়াম করা শরীরে পিটায়া শান্তি। মাইর খেয়ে আমরা সবাই প্রায় সপ্তাহ খানিক ঠিকঠাক চলতে পারিনি। কেউ কেউ হল ছেড়েও গেছে মার সহ্য করতে না পেরে।

শেরে বাংলা হলের ১৬ ব্যাচের এক ছাত্র জানান, প্রথম দিকে আমি হলে থাকতাম না। যার ফলে অনেক বড় ভাইকে চিনতাম না। একদিন হঠাৎ করে এক বড়ভাই (আসিফ জামাল অর্ক কেমিক্যাল ১৫ ব্যাচ) আমাকে তার রুমে ডাকে। তাকে রুমে গিয়ে পাইনি। ঈদের প্রায় ১ মাস ছুটির পর যখন হলে আসলে সোহরাওয়ার্দী হলের পকেট গ্যাটের সামনে সবার সামনে থাপ্পর মারে। এটার কারনে এরপরেও আমাকে অনেক চড়থাপ্পড় খেতে হইছে।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক আরেক ছাত্র জানান, ২০১৮ সালের এপ্রিলের বুয়েটে আমার প্রথম সপ্তাহ ক্লাস। আমি ক্লাস করতাম বাসা থেকে। ক্যাম্পাসে তখন কারো সাথে ঠিক মতো বন্ধুত্বও গড়ে উঠেনি। আমাকে ডাকা হয় বুধবার ক্লাস শেষে। ব্যস্ততার কারনে লাঞ্চও করা হয়নি। আমাকে হলে আনা হলো সিভিলের ১৬ ব্যাচের এ সেকশনের আবরার ও তৌসিফের নেতৃত্বে। আমাকে শেরে বাংলা হলে নিয়ে যেতে বলে ১৭ ব্যাচের এক ছেলেকে দিয়ে। সিগারেট খাই নাকি, প্রেম করি নাকি,নামাজ পড়ি নাকি, কোন দলের সাথে ইনভলভ আছি নাকি জিজ্ঞাসা করা হলো। পরে ওনার অন্য রুমে নিয়ে যায়। মোবাইল নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো। অনেক খোজাখুজি করার পরো কোন রাজনৈতিক দলের সাপোর্ট করা বা তাদেও কোন পেজে লাইক কমেন্ট কিছুই পেলো না। এরপর কোন কারণ ছাড়াই থাপ্পর শুরু হলো। একেকটা থাপ্পড়ে আমি চোখে ঘোলা দেখতেছি। থাপ্পড়ের পর স্ট্যাম্প দিয়ে পেটাতে পেটাতে বলল তোর ব্যবহার ঠিক না। অনেকদিন সুস্থ স্বাভাবিকভাবে হাটাচলা করতে পারি নাই। মানসিকভাবেও অনেক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। পড়ালেখাতেও বাজে ইফেক্ট পড়ে।যা এখনো রিকভারি করতে পারি নাই।

হলের মেছ ম্যানেজাররা পলিটিক্যাল জোরে টাকা মেরে খায় জানিয়ে এক ছাত্র জানান, বুয়েটের হলগূলোতে মেস ম্যানেজাররা পলিটিকাল ব্যাক গ্রাউন্ডের জোড়ে দিনের পর দিন টাকা মেরে খাইসে। ওই টাকায় মদের পার্টি দিসে, বাইক কিনসে। শেরে বাংলা হলে গত ২ বছরে হঠাত বাইক বেড়ে যাওয়ার কারণও এইটা।

বুয়েট ১৩ ব্যাচের এক ছাত্র জানান, ২০১৪ সালে আমাকে সহ আমার ততকালীন রুমমেটদেরকে আহসান হলে ১৪৬ নম্বর কক্ষে বর্তমান বুয়েট ছাত্রলীগ প্রেসিডেন্ট জামিউস সানি, বর্তমান আহসানউল্লাহ হল সাধারণ সম্পাদক লিংকন সরকার স্ট্যাম্প দিয়ে প্রবলভাবে পিঠান। এ ঘটনার পর আমি মানসিকভাবে প্রচন্ড আহত এবং বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। ঘটনার পর আমি আমার বাসায় চলে আসি। এরপর পুরো ৬ মাস আমি বুয়েটে অত্যন্ত আতংকিত অবস্থায় কাটিয়েছি। আমি ক্লাস বাদে বুয়েটের কোন কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারি না। আমার মধ্যে সিনিয়রদের নিয়ে প্রচন্ড ভয় এবং ভীতি কাজ করত। প্রতি বুধবার রাতে হল থেকে পালিয়ে কোন আত্মীয়ের বাসায় চলে যেতাম।এভাবে ভয়াবহ ট্রমার মধ্যে দিয়ে আমার বুয়েটের ফার্স্ট ইয়ার কেটেছে। আমি কোন মানুষের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতাম না। আজ এতদিন পর এটা বলতে চাই, আমি যখন ৫ বছর পরে ভার্সিটি থেকে পাস করে যাওয়ার পরেও এই ট্রমা, এই শারীরিক নির্যাতনের কথা ভুলতে না পারি।

আরেক ছাত্র জানান, ৮ মাস আগে অমিত সাহা আমার হাত ভেঙ্গে ফেলে।কারণ-উনাকে দেখলে সালাম দিইনি। নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির বড় ছেলে আমি। ২১ দিন পর আমার অপারেশন হয় এবং প্লেট লাগানো হয়েছে। যার খরচ ৮০% আমাকে বহন করতে হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছিল সিড়ি থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেছে। জুনিয়র ছিলাম। ভয়ে বলিনি কাউকে।

শেরে বাংলা হলের আরেক ছাত্র জানান, গত ৩ অক্টোবর ২০২ কক্ষে শেরে বাংলা হলের ছাত্রলীগের কর্মী ইফতি মোশারফ সকাল (বিএম ই ১৬), আশিকুল ইসলাম বিটু (কেমিক্যাল ১৬), মুজতবা রাফিদ (কেমিক্যাল ১৬) সহ মোট ৪জন হামলা চালায়। তারা এহতেশামকে (ইইই ১৫) প্রচন্ড মারধর করে। মারধরের পর তাকে রুম থেকে বের করে দেয়। কিন্তু এহতেশামের একটি হাই এন্ড পিসি তারা নিয়ে নেয়। পিসির বাজার মূল্য ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা। এই ব্যাপারে সহকারী প্রভোস্ট শাহিন স্যারকে ফোন দেওয়া হলে তিনি জানান, ‘আমি প্রভোস্ট নই।’ ‘আমি তোমাকে কোন প্রকার সাহায্য করতে পারব না। তুমি আমাকে এত দিন পওে কেন এই ঘটনা জানাচ্ছ?’