পৃথিবী মায়ার খেলা, মায়াবানের মেলা নয়

জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি

হুমায়ূন আহমেদ এক জায়গায় লিখেছিলেন- শাওন তাকে ছাড়া কেমন থাকবে? তখন কি অন্য কোনো যুবকের সাথে প্রেম হবে? হুমায়ূন আহমেদের একটা লেখা আছে 'সংসার'। সেখানে তিনি লিখেছেন যুদ্ধের আগে মা-বাবার সংসার, যুদ্ধের পর মা আর ভাইবোন নিয়ে ভাসমান সংসার, আমেরিকায় গুলতেকিনের সাথের সংসার, দখিন হাওয়ায় শাওনের সাথে সংসার আর সবশেষে নিউইয়র্কে বেলভিউ হাসপাতালের পাশের সংসারের কথা। একজায়গায় তিনি জানতে চেয়েছেন- মানুষের শেষ সংসার কোনটা? মৃত্যু?

তসলিমা নাসরিন একবার হতাশায় লিখেছিলেন- নিজের সন্তান হলে তার নাম দেবো সুখ! আজ জাহাঙ্গীরনগরের বৃষ্টিভেজা রাস্তায় অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশায় ঘুরলাম। ঘুরে ফুচকাওয়ালা, চাওয়ালা, আইসক্রীমওয়ালা আর ঘুরতে বের হওয়া কাপলদের দেখে কেমন যেন ঈর্ষা হলো!
মানুষগুলোর কি সুখ, কি সুখের সংসার! অথচ আমার ক্ষেত্রে সংসার একটা কল্পনা। যার সাথে যখনই গভীর প্রেমে পড়ে সংসার কল্পনা করেছি, বাস্তবতা এসে সেই সংসার ভেঙে দিয়েছে। আমি সেইসব ভেঙে যাওয়া টুকরো কুড়িয়ে আনি প্রতিবার। ভাবি আবার কবে কল্পনায় জোড়া লাগবে আমার স্বপ্নের সংসার?

এক সাক্ষাৎকারে আমাকে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন- কখন মনে হলো লেখক হবো?
আমি বলেছিলাম- যখন দেখলাম জীবনের কিছুই হিসেব মতো ঘটছেনা, যাকে নিয়ে প্রেমে পড়লাম সে মরে গেলো ক্যানসারে। যাকে ভাবলাম সেইই শেষ, তখন আবার শেষ থেকে শুরু! রেলস্টেশনের যেসব বাচ্চাদের সাথে বসে বসে বাদাম খেতাম, ওদের কাউকেও পাইনা। যাদের প্রথম চিঠি লিখতাম তারা কে কোথায়!

বর্ষাকালে যে কদম ফুল ছাড়া চলতোনা, শরতে যে কাশফুলের মাঝে ছবি না তুললে জীবন যৌবন বৃথা হয়ে যাবে ভেবেছিলাম সেসব ছাড়াই একটা শরৎ আর বর্ষাকাল চলে গেলো! আমার আফসোসও হলোনা! ছোটবেলায় যে চকলেট না পেয়ে কেঁদেছিলাম, সে চকলেটের বয়াম দেখে এখন খেতে ইচ্ছা করে না। যে নায়কের মুখ কল্পনা করে সুখ পেতাম শরীরে, সেও বদলে গেছে!

ব্যাকরণ বই ছাড়া কোথাও কেউ লেখেনি- পৃথিবী শব্দের অর্থই হচ্ছে সংসার। বিশ্বসংসার তছনছ করে ১০৮টি নীলপদ্ম কেউ আনবেনা জেনেও নীলপদ্মের বাগান কল্পনা করে জীবন কাটিয়ে দেয়াই জীবনের লক্ষ্য। বাস্তবে অঞ্জন পায়না বেলা বোসের দেখা, সুজাতা পায়না সুখ!

মদের টেবিলের আমুদে লোকটাও, বস্তির খেটে খাওয়া মেয়েটাও দিনশেষে নিস্তব্ধতার মতো একা! যাদের কারণে একা লাগেনা তাদের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকেনা। মায়ার মতোই তারা আসে আর যায়। আর রেলস্টেশনের মতো একাকী পড়ে থাকি আমরা! যে ট্রেন আর ফিরবে না সেই ট্রেনের হুইসেলের মতো হাহাকার বুকে নিয়ে সুখী হই, ভান করি। আমরা মরে যাই, অথচ সূর্য ওঠে আমাদের মৃত্যুকে উপেক্ষা করেই!

বইয়ের পাতায় লেখা হয়ে থাকে- পৃথিবী মায়ার খেলা!

কেবল একা থাকা সংসারী মানুষগুলোই জানি- সত্যিই পৃথিবী মায়ার খেলা, কিন্তু মায়াবানের মেলা নয়!

লেখক ও সাহিত্যিক